শুক্রবার, মার্চ ৩১, ২০২৩
Home > গল্প > মিসট্রাস্ট (সাইকো) | নকীব মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ

মিসট্রাস্ট (সাইকো) | নকীব মুহাম্মদ হাবীবুল্লাহ

Spread the love

শায়ানের মাথাটা বডি থেকে প্রায় আলাদা হয়ে ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে ৷ বুক থেকে দরদর করে রক্ত বেরুচ্ছে ৷ প্রথমে গলাকাটা মুরগির মত করে এদিকসেদিক লাফালাফি করলেও এখন পুরোই নিস্তেজ ৷ “গলাকাটা মুরগির মত লাফানো” উপমাটা সময়ের ব্যবধানেই গলাকাটা মানুশের লাফানোতে পরিণত হলো ৷ শায়ান আমার গার্লফ্রেন্ড ৷ এসব আমার হাতেই হয়েছে ৷ পাশ ঠায় দাঁড়িয়ে দেখতেছি ৷ আমার বাম হাতে এম১৯১১ মডেলের একটা হ্যান্ডগান আইমিন পিস্তল ৷ বাম হাতে স্কুবা টাইটানিয়াম ছুরি, Kn-200T মডেলের এই ছুরিটা কিছুদিন আগেই শায়ানের সাথে ঘুরতে গিয়ে তাইওয়ান থেকে এনেছিলাম, ছুরিটা ওর বেশ পসন্দ হয়েছিলো ৷ ও যদি জানতো যে, এই ছুরিটা ওর নিঃশেষ করার জন্যই লাগবে, তবে হয়ত আর নিতে দিতো না ৷ আমার শরীর দিয়ে ঝরঝর করে ঘাম পড়ছে। বড় বড় শ্বাস নিয়ে হাপাচ্ছি। এমনভাবে হাপাচ্ছি যেনো মৃত্যুশয্যায় কোন মুমূর্ষু প্যাশেন্ট হাপাচ্ছে। বিশ্বাস করতে পারছি না যে, শায়ান আমার হাতে খুন হয়েছে ৷ সময়ের মধ্যে কী হয়ে গেলো, প্রথমে পিস্তলের ট্রিগারে মৃদু চাপ দিতেই ওর গোঙানি শুরু হয়, মাথা বরাবর চালিয়েছিলাম, দক্ষ নই বলে, মাথা থেকে কম করে হলে দশ ইঞ্চি নিচে এসে দুই স্তনের উপত্যকায় গিয়ে লাগে ৷ চিৎকার করে বাঁচার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে৷ চিৎকার দিয়ে বলতে থাকে যে,
-“আমাকে মেরো না প্লিজ ৷ আমি তোমার থেকে সরে যাবো, আর কখনো তোমার সামনে আসবো না৷ প্লিজ এবারের মত ছেড়ে দাও৷ আমার কোনো দোষ নেই ৷ কী হয়েছে খুলে বলো”
কিন্তু আমি তখন কঠিন নির্দয়ের রূপ নিই ৷ আমার ভেতরের মায়া-মমতাবোধ হারিয়ে যায় । যেখানে ওর সামান্য থেকে সামান্যতম কোনো রিকোয়েস্টও আমি কখনো রিজেক্ট করতে পারি নি, সেখানে আজ ওকে খুনই করে ফেললাম ৷ আজ তো আমি ড্রাগ নিই নি, তাহলে এটা কিসের রিয়েক্ট ৷ ফ্লোরে রক্তাক্ত অবস্থায় চিৎ হয়ে পড়ে আছে শায়ানের নিসাড় দেহ ৷ ওর হত্যার দশমিনিট হয়ে গেছে, প্রচণ্ড অস্থিরতা কাজ করছে আমার ভেতর। এই অস্থিরতা শায়ানের ডেড বডি লুকিয়ে ফেলার জন্য নয়। মন থেকে অনুভব হচ্ছে ৷ কী করবো ভেবে পাচ্ছি না ৷ শায়ান আর আমি একসাথেই থাকি ৷ এখনো বিয়ে করি নি ৷ আমাদের বেড়ে ওঠা ওয়েস্টার্ন কালচারে ৷ তাই একসাথে থাকাটা তেমন কিছু না ৷ বাবা-মা এটাকে তেমন কিছুই ভাবেন না ৷ ফ্ল্যাটে আমি একা থাকার চে’ আরেকজন ফ্রেন্ড থাকলে খারাপ হয় না, ভয়-ভীতি থেকে সেফ থাকা যাবে, এমনটি ভেবেই বাবা-মা থাকতে দিয়েছেন ৷ শায়ানের সাথে আমার রিলেশন এগারোবছরের ৷ গতকাল পর্যন্ত ওর প্রতি আমার ধারণা ছিলো যে, শায়ান আমার কাছে পৃথিবীর সেরা মেয়ে ৷ আমার টাকা পয়সার কোনো অভাব-অনাটন নেই, প্রয়োজন হলে বাবার সেক্রেটারিকে মেসেজ দিয়ে বলে দিলেই একাউন্টে টাকা চলে আসে ৷ শায়ানও একরকম আনন্দেই ছিলো আমার কাছে ৷ কোনোকিছুরই অভাব হতো না ওর ৷ সবরকম আনন্দই পেতো ৷ ফিজিক্যালি রিলেশনও অনেক হয়েছে ৷ এটাকে তেমন কিছু মনে করি নি ৷ যদিও বাংলাদেশের ব্যাকগ্রাউন্ডে এটা অনেক বড় একটা ব্যাপার ৷ ওর প্রতি আমি খুব দূর্বল ছিলাম ৷ আমাকে খুব ভালোবাসতো ৷ আমি কখনো চাই নি যে, সেই ভালোবাসাটায় অন্য কারো হাত আসুক৷ তৃতীয় কেউ ওর মধ্যে জায়গা করে নেবে এটা কখনো সহ্য করতে পারি না ৷ আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড রাফানের সাথে দেখে আমার মাথাটা ঠিক রাখতে পারি নি ৷ গতকাল দেখালাম শায়ানকে কিছুদিন আগে জন্মদিনে গিফ্ট করা স্পোর্টস কার Mclaren F1-এ করে ঘুরতেছে ৷ ব্যাপারটা আমাদের কালচারে সাধারণ হলেও আমার সহ্য হলো না ৷ আমার থেকে টাকা নিয়ে আরেকটা ছেলের সাথে ঘুরবে সেটা আমি ভাবতে পারি না ৷ আমিও যে মেয়ে ফ্রেন্ডদের সাথে ঘোরাঘুরি করি, কতকিছুই করি, সেটা আর মাথায় আসে নি। গতকাল আর শায়ান আমার বাসায় আসে নি ৷ না হয় আজকের দিনের আলোটাও দেখতে পারতো না ৷ রাফান আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড হয়ে এমনটা করতে পারলো, ভাবতেই পারছি না৷ কত ক্লোজ ছিলো ৷ আমরা এ টু জেড শেয়ার করতাম ৷ আর ও কি-না সুযোগে আমার গার্লফ্রেন্ডকেই ছিনিয়ে নিলো ৷ কিছুই বুঝতেছি না ৷ আচ্ছা, ব্যাপারটা তো পজেটিভ কিছুও হতে পারে ৷ কিন্তু পজিটিভ ভাবনাটা এসে আর কী হবে ৷ বড় দ্বিধার পৃথিবীতে, এলোমেলো ভাবনায় কখন যেনো সত্য মিথ্যা ভাল মন্দের হিশেবে বড় কাঁচা হয়ে যায় ৷ মাথার ভেতরে যন্ত্রণা বেড়েই চলছে। যন্ত্রণা যত সূক্ষ্ম হচ্ছে, চিন্তা করার শক্তি ততটা লোপ পাচ্ছে। অনেক্ষণ যাবৎ ডুবে আছি। যন্ত্রণা বেড়েই চলছে মাথার। শায়ানের ফোনে কল আসছে, “You Won’t See Me Anymore” গানটা রিংটোন হিশেবে সেট করা। পরাপর বেজেই যাচ্ছে। এত ফোন কে দেয় শায়ানকে, এই সময়ও আমি সন্দেহপ্রবণ হয়ে গেলাম। গানের “You won’t see me anymore/Its time to repay & close doors.” এই কোরাসটি বারবার কানে লাগছে। বিরক্তের সাথে ফোনটা হাতড়ে নিলাম। রাফানের নাম্বার দেখে আমি এবার পজেটিভ ভাবার বিষয়টি মাথায় আসার কারণে নিজেকে কয়েকটা গালি দিয়ে ফোনটা সজোরে ফ্লোরে ছুড়ে মারলাম। সেকেণ্ডের মধ্যেই আইফোন এক্সটি তার মালিকের পথ ধরলো। “রাগের সময় মানুশের দেহে পাঁচটা তরুণের শক্তি ভর করে”। ফোনটি স্পটডেড। আমিই দিয়েছিলাম ফোনটা। ওর ফোন বন্ধ পেয়ে রাফান এবার আমার ফোনে কল দিলো। প্রচণ্ড রাগটা তীব্র থেকে তীব্র আকারে রূপ নিলো। কাছে থাকলে হয়ত রাফানেকেও শায়ানের পথ বেছে নিতে হতো। কিন্তু ওর ভাগ্যের লিখনটা বড়ই ভালো। তিনটা এক্সিডেন্ট থেকে ফিরে আসা তরুণ রাফান। ২টা এক্সিডেন্টে তো ও ছাড়া সবাই স্পটডেড। ওর কপালটা আসলেই ভালো। সোজা বাংলা যাকে চাঁন কপাল বলে। এগারোটা কল দেয়ার পর রিসিভ করলাম, ওপাশ থেকে রাফানের চিন্তাযুক্ত স্বর ভেসে আসলো,
-“কিরে শায়ানকে এত কল দিলাম, রিসিভ করলো না, এখন সুইচড অফ ফোনের, তোরেও কতগুলো দেয়ার পর রিসিভ করলি, কারণটা কী? কিছু হয়েছে শায়ানের?”
-“তোর বউর খবর আমি জানবো কী করে?” প্রচণ্ড ঘেন্নার সাথেই কথাটা বললাম।
-“আমার বউ মানে? মাথা খারাপ হইছে তোর? ডালমোর কয় পেগ খাইছোস?”
-“ফাজলামো করোস আমার সাথে মাদার**”
-“আচ্ছা যাইহোক, শায়ানের থেকে খুশির সংবাদটা শুনে তুই জিনিশ খেয়ে সেলিব্রেশন করতেছোস নাকি?”
-“ফাজলামোর মুড নেই বলতেছি………………………….”
-“আচ্ছা ফাজলামো করলাম না যা, সন্ধ্যায় কিন্তু তোর শপিংমলটা উদ্বোধন হবে জানিসই তো? গতকালই আমরা দু’জন সব ক্লিয়ার করলাম, ঐটার পুরাতন মালিক সেল করে দিয়েছে, পরে শায়ান আমার হেল্প নিয়ে ওইটা তোর জন্য কিনে নিলো। আরে ধুরো, এসব তোকে বলছি কেনো…..। আমাদের সার্কেলের সবাই থাকবে, বাইরের তেমন কাউকে আপাতত ইনভাইট করা হয় নি, যেহেতু শায়ান বলেই দিছে তোকে, আমি আর লুকিয়ে কী হবে। আমরা আসতেছি তোদের নিতে। রেডি হয়ে থাক।”

মানে কী? আমি এখন পুরোটাই ঘোরের মধ্যে আছি। চিন্তাশক্তি ভোঁতা হয়ে আসছে। রুমে হাই পাওয়ারের “Chrome pendant” লাইট জ্বলা সত্ত্বেও আমার কাছে চোখের সামনের সবকিছু্ই অন্ধকার মনে হচ্ছে। এম১৯১১ হাতে নিলাম। হাতে শক্তি নেই, তবুও কোনোরকম মস্তকবরাবর রেখে ট্রিগার চেপে শায়ানের হাতে হাত রাখলাম।

Facebook Comments