বর্তমান সময়ের তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয়তার শিখর ছোঁয়া কবি, ছড়াকার ও উপন্যাসিক রেদোয়ান মাসুদ। তার লেখা উপন্যাস ও কাব্যগ্রন্থ ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। রেদোয়ান মাসুদের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৮ টি। যার মধ্যে ৫ টি কাব্যগ্রন্থ ও ৩ টি উপন্যাস।লেখকের পাশাপাশি উদ্যোক্তাও বটে। তিনি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ তথ্য ভান্ডার ‘বাংলাকোষ’ এর প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও, হেলথ এইড হাসপাতাল লিমিটেড এর পরিচালক ও মোড়াল মিডিয়া বাংলাদেশ এর প্রকাশক। রেদোয়ান মাসুদের জন্ম শরীয়তপুরে। বর্তমান আবাস ঢাকা।
নিজের লেখালেখির জীবনের নানা বিষয় নিয়ে রেদোয়ান মাসুদ কথা বলেছেন অক্ষর বিডির সাথে! সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বর্তমান সময়ের আরেক জনপ্রিয় লেখক এবং অক্ষর বিডির সাহিত্য সম্পাদক নিয়াজ মাহমুদ সাকিবের সাথে।
নিয়াজ মাহমুদ সাকিবঃ কেমন আছেন? করোনাকালে দিন কাটছে কিভাবে?
রেদোয়ান মাসুদঃ আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি, তবে এই করোনাকালে সবাই ভালো নেই। অনেকেরই কাজ নেই, মুখে দু মুঠো অন্ন দিতে পারছেনা ঠিকমতো। আসলে সবাই ভালো না থাকলে নিজেকে ভালো থাকা বলা যায় না। তাই সে হিসেবে বলবো, খুব একটা ভালো নেই। করোনার পুরো সময়টা বাসায়ই কাটছে। আমি যেহেতু ওয়েবসাইট নিয়ে কাজ করছি,তাই ওয়েবসাইটের দেখা শুনা, কন্টেট তৈরি এসব নিয়েই আমার অন্তত বেশ ব্যস্ততায়ই দিন কাটছে।
নিয়াজ মাহমুদ সাকিবঃ লেখালেখির শুরুটা কিভাবে?
রেদোয়ান মাসুদঃ আসলে ছোটবেলায় কখনোই কল্পনা করিনি আমি লেখক হবো। এমনকি অনার্স পড়া শেষেও না। মূলত মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার পরেই লেখালেখিতে আসা। তবে এর আগে বাংলাকোষের কন্টেন্ট নিয়ে কিছু কাজ করেছি। আর সেগুলো ছিল মূলত ইতিহাস বা জীবনী সংক্রান্ত। আর তখনও আমি জানতাম না আমি কোনোদিন কবিতা উপন্যাস আদৌ লিখবো কিনা। মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার পরে একদিন বাড়িতে যাই। আমাদের বাড়ির পিছনে একটা নদী আছে যেটি এখন নাব্যতা সংকটে ভুগছে। আগে নদীতে শুকনা কালেও ঠাই পাওয়া যেতো না, কিন্তু এখন সেই নদীতে শুধু বর্ষাকালে জল আসে আর শুকনা কালে একবারে শুকিয়ে যায়। কৃষকেরা সেই নদীতে এখন ফসল চাষ করছে। আবার কোথাও কোথাও অতিরিক্ত বালির কারণে ফসল বুনলে হয়ও না। বাড়িতে গিয়ে বিকেল বেলা আমি সেই নাদীর পাড়ের রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাজারে যাচ্ছিলাম। এর মধ্যে নদীর এই অবস্থা দেখে বুকের মধ্যে কেমন যেন হাহাকার নেমে এলো। সাথে মনের মধ্যে একটি কবিতাও জাগ্রত হলো। সে সময় আমার হাতে ছিল নোকিয়া ১১০০ মডেলের একটি মোবাইল। সম্ভবত ২০১২/১৩ সালের ঘটনা। তখন আমি মোবাইলের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে ‘এই নদীর তীরে’ নামে ছোট্ট একটি কবিতা লিখে ড্রাফট করে রাখি। পরে ঢাকায় এসে সেটিকে আবার নতুন করে খাতায় লিখে সাজালাম। এই হলো লেখালেখিতে আসার সূচনা।
নিয়াজ মাহমুদ সাকিবঃ লেখালেখি কেমন লাগে ইদানীং?
রেদোয়ান মাসুদঃ আসলে লেখালেখি একটি নেশার জায়গা যাকে একবার পেয়ে বসে তাকে সেই নেশায় ভালোভাবেই ধরে। তাই বলবো লেখালেখিতে এসে অনেক ভালোই লাগছে। তবে প্রথম প্রথম শখের বসে লিখলেও এখন অনেক পরিশ্রম হচ্ছে। অনেক সময় দিতে হয় লেখালেখির পিছনে।
নিয়াজ মাহমুদ সাকিবঃ লেখালেখিতে এসে কি কখনও কোনো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন? হয়ে থাকলে তা কিভাবে মোকাবেলা করেন বা এখনও করছেন?
রেদোয়ান মাসুদঃ এ পৃথিবীতে কোনো কাজই চ্যালেঞ্জ ছাড়া হয় না। সকল কাজেই বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়, লেখালেখিও তো আর এর বাইরে নয়। মূলত একজন লেখককে লেখালেখিতে আসার পর তার বই প্রকাশ নিয়ে নানান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। যদিও প্রকাশকরা বলেন তারা সৃজনশীল পেশায় নিয়োজিত। কিন্তু আজকাল প্রকাশকদের কাছে সেই ধরনের সৃজনশীলতা লক্ষ করা যায় না। সৃজনশীলতা যে একবারে নেই তা বলবো না। তবে যতোটুকুন আছে তা একবারেই নগন্য। এখন আর প্রকশকরা লেখক তৈরি করে মুনাফা অর্জন করতে চায় না,তারা চায় তৈরি হওয়া লেখক অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত লেখক। আপনি ভালো লিখছেন কিন্তু আপনাকে কেউ ডাকবে না, আপনার বই বেশি বিক্রি হচ্ছে আপনাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে যাবে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের বেশিরভাগ বিখ্যাত লেখকের জীবনীতেই দেখেছি, তাদের মধ্যে লেখালেখিত মেধার মেধা দেখলে পত্রিকার সম্পাদকরা তাকে নিয়ে লেখা ছাপতেন, প্রকাশকের কাছে নিয়ে যেতেন বই ছাপানোর জন্য অথবা প্রকাশকরা নিজেরাই যেতেন তার বই ছাপানোর জন্য। কিন্তু এখন আর সেই চর্চাটা নেই। তাই এ নিয়ে নানান সময় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে। আবার দেখা গেছে বই ভালো বিক্রি হলেও প্রকাশকরা ঠিকভাবে রয়্যালিটি দিচ্ছে না! দিচ্ছি দিচ্ছি করে আর কোনো খোঁজ নেই। লেখক আসলে রয়ালিটির জন্য লিখে না। তারপরেও আমি বলবো, একটি বই লেখার জন্য লেখকের অনেক পরিশ্রম করতে হয় । তাই রয়্যালিটির ন্যায্য পাওনা তার খুবই জুরুরি। আবার অনেকে লেখালেখিকে সম্পূর্ন পেশা হিসেবে নেয়। তার জন্য রয়ালিটি পাওয়া আরও বেশি জরুরি।
তাছাড়া একটি বই প্রকাশের পর পাঠকের ভালো লাগা বা না লাগারও একটি বিষয় আছে। একজন লেখক তার সব বই ভালো লিখতে পারে না। কিন্তু কোনো বই একটু খারাপ লাগলেই লেখকদের অনেক কটু কথা শুনতে হয়। বড় বড় লেখকদের ২০০ বই থেকে মাত্র ৫/১০ টা বই বেশি পড়তে দেখা যায় পাঠকদের। তারা বিখ্যাত লেখক হয়েও সব বই ভালো লিখতে পারেনি। তারাও এক সময় তরুণ ছিলেন, অনেক বই লিখেছেন। আর এখন তাদের মাত্র ৫/১০ টা বই টিকে আছে। এখন যারা তরুণ তারা হয়তো অনেক বই লিখবে, এক সময় দেখা যাবে তাদের অনেক বই থেকে মাত্র কয়েকটি বই টিকেবে। আর এটাই সাহিত্যের নিয়ম। হয়তো এই তরুণ লেখকদের মধ্যে সব লেখক এক সময় টিকবেন না, তবে কেউ কেউ তো অবশ্যই টিকবেন। অনেকে চেষ্টা করবে তবে তারমধ্যে হয়তো কেউ কেউ বড় লেখক হবে। আর চেষ্টা না করলে লেখকওবা কিভাবে তৈরি হবে।
আর বাংলাদেশের বেশিরভাগ পাঠকই বইয়ের সঠিক সমালোচনা করতে পারে না। সমালোচনাও কিন্তু সাহিত্যের একটি অংশ। সমালোচনা লেখকদের জন্যও ভালো। কারণ সমালোচনার কারনেই একজন লেখক তার ভুলগুলো বুঝতে পারে, ভুল শুধরে আবার নিজেকে নতুন করে তৈরি করতে পারে। দেশে বইয়ের গঠনমূলক সমালোচনা হচ্ছে না এটাও একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ বর্তমান সময়ে বইয়ের সমালোচনার চেয়ে লেখকের সমালোচনাই বেশি হয়। মানে লেখকরা তাদের লেখার চেয়ে ব্যাক্তিগত আক্রমণের শিকারই বেশি হচ্ছেন। অর্থাৎ কেউ উপরের দিকে উঠলে সবাই চায় তাকে নিচে ধরে নামাতে। আমি যা বলছি, এগুলো শুধু আমার একারই চ্যালেঞ্জ নয়, বর্তমান সময়ে সকল লেখকদেরকেই এই ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আর আমরা লিখতে এসেছি মানে চ্যালেঞ্জ নিতেই এসেছি, তাই এগুলোকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি। তবে যদি এই ধরনের চ্যালেঞ্জগুলো এত বেশি না থাকতো তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আরও ভালো ভালো লেখক বের হয়ে আসতেন। এখন মূলত লেখালেখিতে আসার শুরুতেই অনেক মেধাবী লেখক হারিয়ে যাচ্ছেন, তারা লেখালাখি ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন!
নিয়াজ মাহমুদ সাকিবঃ আপনার প্রকাশিত বইগুলো তো প্রত্যেকটাই পাঠক প্রিয়! এতো পাঠক প্রিয়তা , বই, এসব নিয়ে কিছু বলুন?
রেদোয়ান মাসুদঃ আমার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৮টি। যার মধ্যে ৩ টি উপন্যাস ও ৫ টি কাব্যগ্রন্থ। উপন্যাগুলো হলোঃ অপেক্ষা-১,অপেক্ষা-২ ও অপেক্ষা-৩ আর কাব্যগ্রন্থগুলো হলোঃ মায়ের ভাষা, মনে পড়ে তোমাকে, অনেক কথা ছিল বলার, তবুও মনে রেখো, মন বলে তুমি ফিরবে। আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ মায়ের ভাষা, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৪ সালের একুশে বইমেলায় ও প্রথম উপন্যাস অপেক্ষা-১, যেটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৮ সালের একুশে বইমেলায়। পাঠক প্রিয়তা, এসব আসলে পাঠকের ব্যাপার! ও ব্যাপারে কিছু বলার নেই!
নিয়াজ মাহমুদ সাকিবঃ আগামী একুশে বইমেলা নিয়ে পরিকল্পনা কি?
রেদোয়ান মাসুদঃ এখন তো করোনার সময় যাচ্ছে, তাই আগামী বছরের একুশে বইমেলা হচ্ছে কিনা তা নিয়েই সন্দেহ আছে। তবে বইমেলা হোক বা না হোক যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে তাহলে একটা উপন্যাস প্রকাশিত হতে পারে। ইতিমধ্যে ওটা আমি লিখে ফেলেছি। এখন রিভিউ করছি আর কি।
নিয়াজ মাহমুদ সাকিবঃ খুব অল্প সময়েই লেখালেখিতে এসে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন, আপনার অনুভুতি?
রেদোয়ান মাসুদঃ নিজেকে খুব বড় অবস্থানে এনে দাড় করিয়েছি বলে আমি মনে করি না। বরং আমি বলবো এখনো শুরুর দিকেই আছি। তবে চেষ্টা করছি ভালো কিছু করার। জানিনা, কতটুকু পারবো আর কতোটুকু পারবো না। সে কথা হয়তো সময় বলে দিবে। আর অনুভুতি বলতে খারাপ লাগছে না, বরং পাঠকের এত আগ্রহ দেখে অনেক ভালোই লাগছে নিজের কাছে। মূলত এই পাঠকেরাই আমার লেখালেখির মূল অনুপ্রেরণা। আর ভালো লাগার জায়গাটাও এখানেই।
নিয়াজ মাহমুদ সাকিবঃ আপনি তো একজন উদ্যোক্তাও, নিশ্চয়ই আপনাকে অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়, তবে এত ব্যস্ততার মাঝে লেখালেখিতে সময় দেন কিভাবে?
রেদোয়ান মাসুদঃ আসলে আমি সারা দিনকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে নিই। ঘুমের সময় আলাদা, কাজের সময় আলাদা ও লেখালেখির সময় আলাদা। আমি মূলত রাতের বেলা লেখি। সারাদিন অন্যান্য কাজ করি। আর রাত বলতে রাত দুপুরই বলতে পারেন। লেখালেখিতে মূলত নীরবতার বেশি প্রয়োজন হয়। রাত যতো গভীর হয় পৃথিবীটা ততো নীরব নিস্তব্ধ হয়ে যায়, আর সেসময় আমি শুধু লেখি বা বই পড়ি অথবা লেখা বইয়ের প্রুফ দেখি।
নিয়াজ মাহমুদ সাকিবঃ ভবিষ্যতে কোন দিকটাতে বেশি গুরুত্ব দেবেন, লেখালেখিতে নাকি নিজের তৈরি প্রতিষ্ঠানে?
রেদোয়ান মাসুদঃ আমার কাছে কোনোটাই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। লেখালেখি ও নিজের প্রতিষ্ঠান দুটোতেই সমান গুরুত্ব দেই আমি। তাই আশা করছি, ভবিষ্যতেও এভাবেই চলবে। আসলে পুরোটাই বিধাতার ইচ্ছা। তার উপর ভরসা রেখেই বলছি, আজীবন এভাবেই কাটিয়ে দিতে চাই।
নিয়াজ মাহমুদ সাকিবঃ এত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় দেওয়ার জন্য অক্ষর বিডি পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
রেদোয়ান মাসুদঃ আপনাদেরকেও আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভকামনা!!