হুমায়ূন আহমেদ ও আমার দেয়া অদৃশ্য লাল গোলাপ
জুবায়ের ইবনে কামাল
হুমায়ূন আহমেদ নিয়ে আমার ব্যক্তিগত কোন অভিজ্ঞতা নেই। তিনি যখন দু’হাত ভরে লিখছেন, আমি তখন শৈশব পার করে সবে কৈশোরে উঠেছি। বাংলা বানান পারি বিধায় মাঝে মাঝে বড়বোনের বই থেকে এক দুইটা বই উল্টে পাল্টে দেখি। বেশিরভাগ বইয়েরই কিছু বুঝি না। যেই বইগুলো আমার আপু চোখ বড় বড় করে পড়ে, সেগুলো আমি পড়লে বড্ড পানসে লাগে। কিন্তু একদিন একটা বইয়ের গল্প আমার এই ধারণাকে পাল্টে দিলো।
বইটার নাম ছিলো—নীল হাতি। বাচ্চাদের বই বটে। সেখানের মূল চরিত্র বাচ্চা মেয়ে নীলা। বিদেশে থাকা নীলার মামা কখনও দেশে আসে না। একদিন ছোট্ট মরিচের মতো দেখতে আঙ্গুলগুলো দিয়ে ভাঙা ভাঙা অক্ষরে বিদেশী মামার কাছে চিঠি লিখলো নীলা। সেই চিঠির অপর পাতায় নীলা এঁকে দিলো একটা গ্রামের ছবি। যেখানটায় হলুদ সূর্য উঁকি দিচ্ছে।
নীলা অপেক্ষা করে রইলো কিন্তু চিঠির কোন জবাব এলো না। বহুদিন পর এক বৃষ্টিভেজা সকালে পিয়ন এসে নীলাকে দিলো একটা কাগজে মোড়ানো বাক্স। যার মধ্য থেকে বেরিয়ে এলো অদ্ভুত খেলনা—নীল হাতি। সেই নীল হাতিটা নীলা কোলে করে ঘুমায়। হঠাৎ একদিন একটা দুষ্টু ছেলে এসে নীলার হাতিটা নিয়ে চলে গেলো। তারপর কীভাবে হাতিটা জীবন্ত হয়ে গভীর রাতে ফিরে এলো নীলার কাছে, সেই রোমাঞ্চকর গল্প আমার কোমল মনে প্রচন্ড আন্দোলিত করলো। আমি জানতে পারলাম, এই গল্পটা লিখেছেন বয়স্ক দেখতে এক লোক, নাম—হুমায়ূন আহমেদ।
তারপরের জন্মদিনে আমার বড়বোন আমাকে উপহার দিলেন একটা হলুদ রঙা বই। হিমু এবং হার্ভার্ড Ph.D.বল্টুভাই নামের বইটা আমি এক বিকেলে পড়ে শেষ করেছিলাম। কী সুন্দর গল্প! হুমায়ূন আহমেদ কী দুষ্টু! প্রতি সপ্তাহে বইটা একবার করে পড়ি। মাঝে মাঝে মহল্লার পাঠাগার থেকে বড়বোনের নাম সাইন করে হুমায়ূন আহমেদের আরও বই আনি। এভাবে দিন যাচ্ছে। দেড়শো মত বই পড়ে ফেলেছি হুমায়ূন আহমেদের। কেউ তার লেখা নিয়ে বাজে কথা বললে মুখ ভার করে থাকি। তার সঙ্গে আড়ি ভেবে তিনদিন কথাও বলি না। এভাবেই যখন আমার আনন্দের দিন কাটছে, ঠিক সেরকমই এক সকালে উঠে (১৯শে জুলাই ২০১২) এফএম রেডিওতে খবর শুনলাম দুষ্টু হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে নিউইয়র্কের বেলেভ্যু হাসপাতালে মারা গেছেন।
আমার বড়বোন কলেজ থেকে ফেরার পথে শহিদ মিনারে লাইন ধরে হুমায়ূন আহমেদের লাশের সামনে দুইটা গোলাপ ফুল দিয়ে এলো। একটা ওর পক্ষ থেকে, আরেকটা আমার পক্ষ থেকে। আমি ছোট, মা যেতে দেননি। তাই আমার পক্ষ থেকে হুমায়ূন আহমেদের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানালো আমার বড় বোন, সুমাইয়া বিনতে কামাল।
২.
কিছুদিন আগে ফেসবুকে দেখলাম হুমায়ূন আহমেদ নিয়ে বেশ ঝগড়াঝাটি হচ্ছে। পোস্টটা দিয়েছেন সাহিত্য নিয়ে কাজ করা একজন গবেষক। আমি কমেন্ট করে ঝগড়ায় অংশ নিলাম। পোস্টদাতা ভদ্রলোক আমার কমেন্ট দেখে মেসেঞ্জারে ফোন করলেন। আমি ভাবলাম, ‘কমেন্ট করে এ কী বিপদে পড়লাম খোদা!’ তিনি ফোনে আমাকে বললেন, হুমায়ূন আহমেদ নিয়ে একটা ক্রিটিক লিখে আমি যেন তাকে দেই।
জীবনের প্রথম সাহিত্য সমালোচনা লিখতে গিয়ে খাটের নিচ থেকে বের করলাম হিমু সমগ্র, মিসির আলী সমগ্র, বাদশাহ নামদার, মাতাল হাওয়াসহ আরও পুরনো অনেক বই। বুকশেলফ থেকে নিলাম প্রফেসর মোহাম্মদ আজমের লেখা হুমায়ূন আহমেদ পাঠপদ্ধতি ও তাৎপর্য। টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছি লেখার জন্য। মাইক্রোসফট ওয়ার্ড খুলে লিখতে বসে দেখি মাথাভর্তি হওয়া লেখাগুলো আসছে না। কীবোর্ডে খটখট আওয়াজ করে লিখি, কিন্তু প্রথম লাইন হিসেবে একদমই পছন্দ হয় না। ডিলিট বাটনে প্রেস করে ধরে রাখলাম, সব মুছে গেলো। আবার কীবোর্ড খট খট খট …।
ভাবলাম, সিরিয়াস সাহিত্য পড়ে পড়ে এই অবস্থা হয়েছে। কিছুই মাথায় আসে না। তখনই হুট করে মনে হলো, সিরিয়াস সাহিত্য আসলে কী? হুমায়ূন আহমেদের বই যখন পড়তাম, আনন্দ নিয়ে পড়তাম। সিরিয়াস সাহিত্য দূরে থাক, সাহিত্য জিনিসটা কী তাই বুঝতাম না। তবে এই ‘সিরিয়াস সাহিত্য’ জিনিসটাই কি আমাদেরকে গল্প থেকে দূরে সরিয়ে দিলো? এবার পুরোদস্তুর দুহাতের দশ আঙ্গুলে আমি হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য সমালোচনা লেখা শুরু করলাম ঠিক এভাবে :
ইদানীং সিরিয়াস সাহিত্য বলে একটা ব্যাপার ঘটেছে। এতে অবশ্য সমালোচকদেরই সুবিধে। কারণ, তারা সমালোচনা করার জন্য লেখা ‘পছন্দ’ করতে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকেন। বাংলাদেশের সাহিত্যে তো বটেই; বরং বাঙলা ভাষা সাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদের লেখা নিয়ে সম্ভবত সমালোচকদের এরকম একটি বিভ্রান্তিমূলক মনোভাব রয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ যখন লিখতে শুরু করেছিলেন তখন সমালোচকদের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব থাকলেও ক্রমেই তিনি ‘সিরিয়াস’ সাহিত্যের নিরিখে সমালোচকদের মধ্যে ভাগ করে ফেলেছেন। তবে আশা কিংবা হতাশার কথা হলো, সেসব কিছুই পাঠকদের তেমন ভাবে স্পর্শ করেনি।
এখন প্রশ্ন হলো, বিশ্বসাহিত্য পড়ে আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করে হুমায়ূন আহমেদের লেখার কী জিনিস আবিস্কার করলাম? অনেক জিনিসই আবিস্কার করলাম। নভেলা বা উপন্যাসিকার বিস্তর নিরীক্ষা আবিস্কার করলাম। সাথে পেলাম ‘হুমায়ূনীয় গদ্য’ নামক গায়েবি এক ধারণা। হুমায়ূন আহমেদের ভাষাশৈলির বাইরে তার লেখার একটি গুরুত্বপূর্ন ভঙ্গিমা হলো সংলাপ নির্ভর কথামালা। কোন ঔপন্যাসিকই শুধুমাত্র সংলাপ দিয়ে গল্প ফাদতে পারেন না। গল্পের খাতিরেই তার বহুল বর্ণনা প্রয়োজন হয়। হুমায়ূন অন্তত এক্ষেত্রে একদমই আলাদা। আমরা জানি হুমায়ূনের অনেকগুলো চরিত্র রয়েছে। এবং সেগুলো স্বতন্ত্রভাবে জনপ্রিয়ও বটে। মুশকিল হলো, তার সব লেখাতেই সংলাপের আধিপত্য বেশ চোখে লাগার মত। সংলাপ নির্ভর লেখায় দুটো সমস্যা আছে।
এক—আক্ষরিক অর্থেই ভাষা নিয়ে অনেক বেশি সচেতনার প্রয়োজন হয় না। যেহেতু ফিকশনের প্রতিনিধি চরিত্ররা নিজের ডিসকোর্স অনুযায়ী কথা বলছেন সেহেতু যা ইচ্ছা বলানো যায় এবং সেটা খুব একটা উঁচুদরের হয় না। কারণ আগেই দেখেছি যে হুমায়ূন গল্প লেখার চেয়ে গল্প বলতেই বেশি পছন্দ করতেন। তাছাড়া সেটা অতিরিক্ত সরল হওয়ার কারণে অনেক সময়েই বাছবিচারহীন ভাবে তরলের অভিধা পেয়ে থাকে। আর দুই নম্বর সমস্যা হলো—আসলে বর্ণনাকে থামিয়ে শুধু সংলাপ দিয়ে কোনভাবেই চিন্তার পরাপম্পরা রক্ষা করে লেখা সম্ভব হয় না। বর্ণনা রাখাটা কিছুটা আবশ্যিক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এই সমস্যার জায়গাকে সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে সমাধান হিসেবে ব্যবহার করেছেন হুমায়ূন আহমেদ। উদাহরণ হিসেবে আমার আছে জল বইটিকে আমরা সামনে আনতে পারি। গল্প যেখানে শুরু হচ্ছে সেখানে ওসমান সাহেবকে আমরা ট্রেন থেকে নেমে অনেক জিনিসপত্র সহ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। এবং বাংলোতে পৌঁছানোর জন্য থানা কতৃক আকাঙ্খিত আনজাম না হতে দেখে স্থানীয় ওসির প্রতি ওসমান সাহেবের ক্ষুব্ধ হতেও দেখা যায়। এই পুরো ব্যাপারটি আসলে হুমায়ূন তৈরি করেছেন তার স্বভাবসিদ্ধ বর্ণনা করা ছাড়াই। ওসমান সাহেবের পদমর্যাদার মত ব্যাপারটিও বর্ণনায় না এনে সংলাপের মাধ্যমে হুমায়ূন তৈরি করেছেন। আমরা দেখি ওসমান সাহেবের স্ত্রীর সংলাপে তিনি তার স্বামীকে বলছেন, তিনি এখন আর আইজি নন, তাই যেন তিনি সেরকম সুযোগ সুবিধা আশা না করেন। এই একটি সংলাপেই গল্পের এই চরিত্রগুলোর শ্রেণী সাবধানতা এবং পরিবারকাঠামোর গভীরতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সুতরাং সংলাপ নির্ভর সমস্যার জায়গায় দাঁড়িয়ে হুমায়ূনের লেখা অবশ্যই শক্তিশালী।
বাজে হুমায়ূন নামের একটা বইয়ে হুমায়ূন নিয়ে আমার একটা লেখা আছে। সিরিয়াস সাহিত্যের নিরিখে হুমায়ূনের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে হাবিজাবি লেখা। সেটা সেদিন খুলে দেখলাম, আমার লেখার সঙ্গে সেখানে একাধিক প্রফেসর আর বড় বড় মাপের লেখকদের লেখা দিয়ে ভর্তি। তাদের লেখাগুলো পড়তে পড়তে মনে হলো, প্রায় দশ বছর আগে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া একটা লোকের লেখায় কত বেশি প্রভাব থাকলে, আমার তার সাহিত্য এখনও পড়তে হয়?
৩.
একটা বিষয় বলে এই লেখা শেষ করছি। পপ কালচারের একটা দারুণ জিনিস আমার ভালো লাগে, সেটা হলো ডিজিটাল মাধ্যমে স্যাটেয়ারের অন্যরকম বহিঃপ্রকাশ, ইংরেজিতে বলে মিম (meme)। মিম কালচার এখন অনেক প্রতিবাদ ও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুর অন্যতম ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবাক হয়ে খেয়াল করে দেখলাম, সেখানের মুল উপাদান হলো হুমায়ূন আহমেদের নির্মিত নাটক ও চলচ্চিত্রগুলো। যেন বা আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে বসে উনি ভেবে ফেলেছিলেন, এই সময়ের ভাষা কেমন হবে। নাহলে কেনই বা তিনি ক্রসফায়ারের যুগে লিখেছিলেন, হলুদ হিমু কালো র্যাব?
আমরা জানি না …।