অক্ষর বিডি ডটকম : একজন হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন বলেই গল্প পড়া শিখেছি। এই কথাটা বলা খুব অত্যুক্তি যে হবে না তা হলফ করে বলতে পারি আমি। সেটা পাঠক হিসেবে। গল্পের জাদুকর এ অসীম উচ্চ মানবকে নিয়ে তো কম স্তুতি-প্রশংসা হয়নি। নিন্দাও হয়েছে কিছুটা। ও হবেই। যারা করে তারা করবেই। সবকালেই, সবযুগেই এদের আনাগোনা থাকে সাহিত্যপাড়ায়। তবে, দিনশেষে দেখা যায় কি পাঠক সন্ধ্যা বা বিকালে হুমায়ূন পড়ে আর সেলফে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে নিন্দুকদের বই। যদি তাদের বই কেনা হয় আরকি!
এবার অন্য কথা বলি। একজন লেখক কি পরিমাণ সমৃদ্ধ হলে পাঠককে ঠায় বসিয়ে রাখতে পারেন সবসময়। তার সব লেখার সামনে। কতটুকু শক্তি ও প্রভাব রাখলেই কেবল তার চরিত্র ধারণ করতে ভবঘুরে হয় পাঠক। এটা খুব সামান্য কিছু না। মাত্রই, এখন এই লেখাটি লিখতে গিয়েই কথাটি মনে হল আমার। আপনি একজনের লেখা পড়ে তার চরিত্র নিজের ভেতর প্রয়োগ করতে চাইবেন। এটা কি এমনি এমনিই। হিমু, মিসির আলি চরিত্রকে যদি আপনি একটি মিথ ভাবেন তাহলেও কিন্তু ঘোল মেটে না। ভাবা যায় এ অস্পৃশ্য চরিত্র দুটোর কি আকর্ষণই না ছিলো। আপনাকে খালি পায়ে ঘোরাবে। হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে নিয়ন আলোয় শহর দেখাতে নিয়ে যাবে এটা কি অতই সোজা। আর এসবের পেছনে কলকব্জা নেড়েছেন কে! হুমায়ূন আহমেদ নিজেই। তার সৃষ্টি অসংখ্য চরিত্রের এই দু’জনকে হুমায়ূন আহমেদ একটু অন্যভাবেই গড়েছেন। যা আমাদের অনুভবে এসে টোকা মেরে যায়। এমন সাবলীলভাবেও কি এ অলীক অনুভবস্পর্শ চরিত্র সৃষ্টি করা সম্ভব। আমার কাছে মনে হয় এটাও পরাবাস্তবতার একটি পার্ট। আধুনিক সাহিত্যে যে জাদু বাস্তবতা ধরে আমরা পূজো করি। মিসির আলি, হিমুতে হুমায়ূন কি সেই পরাবস্তব, জাদুবস্তব বা অস্বাভাবিক চরিত্রের সফল প্রকাশ ঘটাননি? তবে আমি বলছিনা মার্কেজ আর হুমায়ূন এক। দু’জন দুই মেরুর। একদম আলাদা। মার্কেজকে দুনিয়া চেনে। কিন্ত হুমায়ূন আহমেদকেও বিশ্বমানের লেখক বলবো আমি। তাই কি না আমার কাছে মনে হয় মার্কেজের জাদুর মতোই হুমায়ূনের জাদু। মিসির আলি আর হিমুকে একরকম জাদু চরিত্রই মনে করে আমি। কারণ, এসব বা তাদের এমন সব উদ্ভটতা আদৌ কি তা বাস্তবে ঘটে!
একটু ঘুরিয়ে বলি, একটা অপ্রকৃতস্থ অভিযোগ শুনি মাঝেমাঝে। বাতাসের কানকথা মনে করে ধূর বলে একপাশে চলি আসি শুনলে। সেটা হলো ‘হুমায়ূন নাকি সস্তা পাঠকরা পড়েন। তার লেখায় আহামরি খুব কিছু নেই। এই অমূলক প্রস্তাব যারা রাখেন তাদের উচিৎ খুব মনোযোগ দিয়ে আবার হুমায়ূনকে শৈশবকালীন পাঠ নেয়া। হুমায়ূন আহমেদ তার লেখায় এই পরিমাণ শিল্পী, সাহিত্যিকদের কথা এনেছেন। টেনেছেন তাদের শিল্পীত্ব ও সাহিত্যিক মূল্যয়নের কথা যা ইতোপূর্বে বাংলা সাহিত্যের কোন গল্পকার তার গল্প বা জীবনমুখী উপন্যাসে লিখেছেন কি না জানি না। কই আমরা তো হুমায়ূন আহমেদ পড়েই খুব মনোযোগ দিয়ে বিকেল, সন্ধ্যা, রাত এক করে পড়তে শিখেছি। হুমায়ূন পড়তে পড়তেই পাঠ নিয়েছি বিশ্ব সাহিত্যের। খুব যে নিয়ে ফেলেছি তা নয়। তবে যতটুকু কুলিয়েছে ততটুকু পড়েছি। একটু ভালো করেই পড়েছি।
হুমায়ূন আহমেদ তো বিস্তর প্রবন্ধ লিখেননি। জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয় আর শিল্প সাহিত্যের ম্যাগাজিনে পাতার পর পাতা ভরেননি সাহিত্য সমালোচনা দিয়ে৷ মানে হুমায়ূন তা করেননি। তিনি তার পুরো জীবনকে ব্যয় করেছেন একটি সমাজ ও জীবনকে স্পর্শ করায়। বলা হয়, মধ্যবিত্ত জীবনের প্রধান সুরটাই তার গল্প, উপন্যাসে সবচেয়ে বেশী ফুটে উঠেছে। তো সেটাই। তিনি এই জীবনবোধ ও বাংলা গল্পের সহজ, তরল, বোধগম্য গদ্যের দিকে মনোযোগী হয়েছিলেন। এটিতে ভেঙেচুরে কাজ করেছেন। ব্যাস! এরপর যখন চলে গেলেন, রেখে গেলেন সফলতার দাগ। অর্থাৎ তিনি তার কাজের, শিল্পের জায়গায় প্রধান শিল্পী হয়েই বিদায় নিলেন। সবাই সমস্বরে বলছে ‘এই ধারায় তার চেয়ে আর কোন বড় শিল্পী নেই’। তার কাজে তিনিই শ্রেষ্ঠ। ল্যাঠা তো এখানেই চুকে যায়। তিনি তো আর ভাষা বিজ্ঞানে কাজ করেননি। করতেও চাননি। প্রবন্ধ, নিবন্ধ লিখে একজন বুদ্ধিজীবি সাহিত্যিক খেতাব অর্জনের আকাঙ্ক্ষা ছিলোনা তার। যদি চাইতেন তাহলে পারতেন না এটা ভাবা যায় না। কারণ, রসায়নের অধ্যাপক হয়ে যে লোক নিজস্ব ধারায়, কুশলতায়, গল্প, সাহিত্যে এই বিপ্লব ঘটান সে কি পারতেন, আর পারতেন না তা একটু নির্মোহ হয়ে ভাবুন।
বলা হয় পুরস্কার একজন লেখককে খ্যাতি এনে দেয়, কিন্তু তাকে বাঁচিয়ে রাখে তার লেখা৷ লেখকের পুরস্কার অর্জন ও লেখার সাহিত্যিক মান মূল্যায়ন ভিন্ন জিনিস। হুমায়ূন কি এই জায়গাটা উতরে যাননি। তার কাজের জায়গায়, নিজ ধারার গল্প বুননে সেকি সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠে যাননি! এখনো গল্প ও জীবনমুখী উপন্যাসে এক শতাব্দী রাজ করার রসদ দিয়েই তবে গত হয়েছেন গল্পের জাদুকর। আজ তার জন্মদিন। একজন ক্ষুদ্র ভক্ত পাঠক হিসেবে তাকে জানাই শুভজন্মের কথা৷ অভিমানও আছে এভাবে হুট করেই কেন চলে যেতে হবে আপনাকে৷