শুক্রবার, মার্চ ৩১, ২০২৩
Home > গল্প > বাঘ বিধবা-২ – কিঙ্কর আহ্সান

বাঘ বিধবা-২ – কিঙ্কর আহ্সান

Spread the love

সে প্রতিশোধ নেবার সময় আর হয়না। শীতের মতন নির্জীব মা মোর্শেদ আলীকে নিয়ে সংসার চালানোর চেষ্টা করে। লাভ হয়না। ভাতার টাকা অতি অল্প। বিধাব মা ঘর চালাতে নদীতে কাঁকড়া আর রেনু ধরতে বের হয়। ওতে খাবার জোটানো যায় কিছুটা হলেও।
মোর্শেদ বনে যেতে চায়। বয়স তো কম হয়নি। তাকত আছে শরীরে। কাঠ কাটার সময়।
মা রাজি হয় না। হাত, পা ধরে। কসম কাটে। বলে, ‘তোর বাপ গ্যাছে অই জঙ্গলে। তোরে আর হারাইতে পারবু না।’ মোর্শেদ আলী মায়ের কথায় বিরক্ত হলেও কথাটা শোনে। তাকে হারানোর ভয় বুকে পুষে শীতের মতন নির্জীব মা’টা একদিন নিজেই হারিয়ে যায়।
ততদিনে বিয়ে হয়েছে মোর্শেদ আলীর। মা’ই ছেলেকে ঘরে রাখার জন্য করেছে এই কান্ড। বউয়ের রসে মজবে ছেলে। জঙ্গলে যাবেনা। বোকা মা। শীতের মতন নির্জীব বউ এনেছে ঘরে। বাবার মতনই মোর্শেদ বসন্ত ঋতুর জন্য পাগল। শীতে শরীর উষ্ণ হয়না। ওতে ওম ওম গরমের আরাম নেই। বউয়ের সাথে তিক্ততা শুরু হয়। করলা তিতা জীবন।
মোর্শেদ নানান কথা চিন্তা করতে করতে কাঁশে। চুলায় ভাত। আগুনের ভেতর কি যেন পট পট করে ফোটে। লাকড়ি জ্বলতে চায়না এই শীতে। ভিজে শেষ।
মোর্শেদ আলির কাঁশির দমকে একসময়ে ঘুম ভাঙে আকলিমার। উঠে এসে দাড়ায় মোর্শেদ আলির পাশে। পরনের শাড়ি আলুথালু। আটসাট পুরনো ব্লাউজের আড়াল হতে বের হয়ে আসার জন্য আকুল উদ্ধত্ব স্তন। আকলিমার দিকে তাকায় মোর্শেদ আলি। তাকিয়ে হাসি দেয়। আর কিছু না। নারীর চেয়েও তার কাছে বরাবরই আকর্ষনীয় গহীন অরণ্য। এসব জানে আকলিমা। তাই বনে না। বেহুদা পুরুষে শান্তি নাই। করলা তিতা জীবনটা আরো তিতা করতে আকলিমা গালিগালাজ শুরু করে। ক্যান পুরুষমানুষ পাকঘরে (রান্নাঘর) ঢুকল এই হল অপরাধ। মোর্শেদ কথা বাড়ায় না। পাকঘর এর কাজ বুঝিয়ে দিয়ে খাটের ওপর গিয়ে বসে। আকলিমা গজগজ করে যায়। মোর্শেদ আলি চুপ থাকে। আজ আর কথার পিঠে কোনো কথা হবেনা। আকলিমার শেষ দিনটায় মেনে নেওয়া হবে সব। তার শেষ খাওয়াটা নিজ হাতে রান্না করে খাওয়ালে ভালোই লাগত মোর্শেদ আলির। সেটা হতে দিলোনা আকলিমা নিজেই।
বসে বসে সব ঠিক করে মোর্শেদ আলি। এই দিনটার জন্য অপেক্ষা ছিলো অনেকদিনের। বাঘকে বাগে আনে সময় এবারই। কম তো চেষ্টা হয়নি। পারেনি কোনোবারই। এবার লোভনীয় টোপ। বাঘ ধরা না পড়ার কোনো কারণ দেখছে না সে।
গত রাতে সিংগীমারি গ্রামে বাঘ ঢোকার সময়েই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল সব। কাজ চলছে সে অনুযায়ী। বিছানায় বসে চারপাশটা দেখে নেয় আরেকবার মোর্শেদ আলি। ঘরটা এখনও শক্ত পোক্ত। কাঠের বেড়ার ওপর টিনের চালার ঘর। ধার-দেনা করে নতুন করা হয়েছে। বাড়ির একদিকে লোনা পানির খাল আর আরেক পাশে চিংড়ির ঘের। বাঘ লুকানোর জন্য খালের দিকটাই বেছে নেবার কথা। জংলা জায়গা। নিজেকে আড়াল করা যায় সহজে। গত রাতে টিন পিটিয়ে জানানো হয় বাঘ আসার কথা। মোর্শেদ তাই তাড়াহুড়ো করে ঘরে ঢুকে খিল দেয়। ততক্ষনে কয়েক বাড়ির মুরগী আর ছাগল হাওয়া। শোনা যায় আশপাশের বাড়ি থেকে আসা কারো কারো কান্না। এরপর সব চুপ। একদম নীরব, নিঃশব্দ।
ঘটনা কয়েক দিন আগের। গত সপ্তাহে বাঘ বাজার থেকে ফেরার পথে হামলা চালায় পূব কোনার ঘরের বাবলুর ওপর। হাত আর বুকের একপাশের ওপর দিয়ে যায় বিপদ। কোনোরকমে বেঁচে যায় বাবলু। বনকর্মীরা খোঁজ লাগায় বাঘের। বাজি পোড়ায় যাতে গহীন অরণ্যে চলে যায় বাঘটা।
বাঘ যায়নি। বাঘ আছে। মানুষের মাংসের স্বাদ পেলে ফিরে আসতেই হয়। বাঘ এই নেশার টান এড়াতে পারেনা। এক জীবনে কম তো দেখলো না মোর্শেদ। ভেড়া, ছাগল কত কিছু দিয়েই না ফাঁদ পাতলো! কাজ হয়নি। চালাক প্রাণী। অত সহজে কাছে আসবে না। টোপ হিসেবে মানুষই ভালো। মানুষের মাংসের স্বাদ এড়ানোর সাধ্য নেই কোনো বাঘের। কিন্তু মানুষ কই পাওয়া যায়? মরা কিংবা জ্যান্ত মানুষ!
পুতাটা জায়গামতন লুকিয়ে রেখেছে মোর্শেদ আলী। মুগুরের চেয়ে কম নয়। মাথার ঠিক জায়গায় এক ঘা পড়লেই যথেষ্ট। খুব বেশি রক্তপাত হবে বলে মনে হয়না। তারপর মৃতদেহটা টেনে ফেলা হবে ঘরের বাইরে। বাঘ মানুষের শরীরের গন্ধ টের পাবে ঠিক ঠিক। ছুটে আসবে মোর্শেদ আলীর বউয়ের নরম মাংসের লোভে।
আকলিমা নিজেই খাবার তৈরি করে। আলু ভর্তাটা ভালো মতন চটকায়। বোম্বাই মরিচের অর্ধেকটা দেয় সাথে। এই মরিচের গন্ধ মোর্শেদ আলীর পছন্দ। সাথে বেগুন ভাজির এক টুকরা। একটু সময়ই লাগে সব তৈরি। সময় নিয়েই করে। ক্ষিধে লাগুক মোর্শেদ আলীর। ক্ষিধেটা দরকার।

<- বাঘ বিধবা প্রথম পর্ব

বাঘ বিধবা তৃতীয় পর্ব ->

Facebook Comments
Facebook Comments