রিভিউ লেখক: আনিসুর রহমান
বিলালঃদাসত্বের শেকল ভেঙ্গেছিলেন যিনি
-আবিসিনিয়ার(বর্তমানে ইথিওপিয়া) ধূ ধূ মরুভূমি৷ মরুভূমি শেষে পাহাড়ঘেরা অপরুপ সৌন্দর্যের একটি গ্রাম৷ সবুজ ঘাসের উপর খেলা করছে একটি শিশু, হাতে কাঠের তলোয়ার, কাঠের তৈরী ঘোড়ার উপর ভর করে দৌড়ে সামনে যাচ্ছে শত্রু বিনাশের উদ্দ্যেশ্যে,বোন গুফাইরার চাতুরীতে হঠাৎ পা পিছলে পড়ে যায়৷ এ নিয়ে বোনের সাথে খুনসুটির ঝগড়া, মা এসে হয় মধ্যস্ততাকারী, মায়ের বুকে লুটিয়ে পড়ে দু শিশু৷ এক টুকরা স্বর্গ-সুখের সংসার৷তখনই দিগন্তে ধুলি উড়িয়ে ঘোড়ায় চড়ে ছুটে আসা একদল দস্যু, মা আঁতকে উঠে, শিশুদের লুকিয়ে ফেলেন, শেষ রক্ষা হয় না৷ দস্যুরা তুলে নিয়ে যায় ভাই-বোনকে৷ বিক্রি করে দেয় মক্কার বিশিষ্ট ধনকুবের উমাইয়ার কাছে৷ শুরু হয়ে যায় একটি শিশুর ভয়ংকরময় ক্রীতদাসের জীবন৷
– প্রাক ইসলামী যুগের মক্কা৷ কাবা শরীফ প্রাঙ্গন,পবিত্র কাবা শরীফের উপর বিশাল মূর্তি৷ কাবার প্রধান পুরোহিত মানুষের মনে কল্পিত ঈশ্বরদের ভয় জাগিয়ে লোকজন থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে৷ একটি শিশু, তিনদিন ধরে খাবার খেতে না পেয়ে ক্ষুধার্ত আর তৃষ্ণার্ত৷ কাবার সামনের মানুষজনের কাছে কাতর সুরে খাবারের জন্য পয়সা চাইছে৷ তার দিকে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই৷কল্পিত ঈশ্বরের ভয়ে সবাই তটস্থ,তাই ঈশ্বর কৃপার জন্য মূর্তির থালা পয়সায় পূর্ণ হচ্ছে, শিশুর আর্তনাদে তাদের কিচ্ছু যায় আসে না৷
– মাটির নিচে অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি প্রকোষ্ট৷ একজন বন্দির হাত-পেছন থেকে খুটির সাথে বাঁধা৷ সারা রাত ধরে চলা চাবুকের আঘাত মাত্র কিছুক্ষন আগে শেষ হয়েছে৷ সুবহে সাদিকের সময়৷মায়ের কথা মনে পড়ে যায় বন্দির৷ একদিন মা তাকে বলেছিল,”ঘোড়া আর তলোয়ার থাকলেই কেউ মহৎ যোদ্ধা হতে পারে না৷ সে মহৎ যোদ্ধা, যে মনের ভেতরকার সকল বন্ধন ছিন্ন করতে পারে” জবাবে সে বলে উঠে “সে বন্ধন তো আমি দেখতে পাই না৷ কিভাবে সে বন্ধন দূর করব?” শিশুকালে সে তার ভেতরকার বন্ধন দেখতে পায় নি৷ কিন্তু আজ সেই শেকল সে নিজের মধ্যে অনুভব করছে৷কলুষনের সে বন্ধন থেকে মুক্ত হবার তীব্র বাসনা তাকে গ্রাস করে ফেলেছে৷ তখন ই এক ঝটকা আলোয় ঝলসে উঠে তার মুখ,তার দেহ৷ মুক্তি হয় সে৷ সে মুক্তি দৈহিক নয়,জীবনভর নিজের মধ্যে বয়ে চলা শিকল থেকে মুক্তি, সে মুক্তি আত্মিক, হিংসা- লোভ-লালসার দাসত্ব থেকে মুক্তি৷
ছোট ছোট দৃশ্যের বর্ণনাগুলো বিলাল: এ নিউ ব্রীড অফ হিরো মুভির৷ এরকম আরও বহু মিনিংফুল দৃশ্যের সাক্ষাত পাওয়া যাবে আয়মান জামাল পরিচালিত এই অ্যানিমিশন মুভিতে৷
-হযরত বেলাল (রাঃ) এর জীবনভিত্তিক এই সিনেমার প্লট মূলত দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্তি ও তার পরিণতিকে উপজীব্য করে সাজানো৷ প্লটটা ইউনিক৷ প্লটে পরিচালক যে স্টোরিটা বলতে চেয়েছেন তা ঠিকঠাক মতো বলতে পেরেছেন৷ গল্পের মূল সুর থেকে একচুলও ভিন্ন দিকে কাহিনীকে টেনে নিয়ে যান নি৷ যদিও সে সম্ভাবনাটা অনেক বেশি ছিল, কারণ প্রাক ইসলামী যুগে ইসলামের ইতিহাস প্রচুর শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত ছিল৷ এসব শাখা প্রশাখায় ঢুকলে মুভির থিমটা ঠিক মতো উপস্থাপন করা সম্ভব হতো না৷
-সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রভু ও তার ক্রীত ভৃত্যের মধ্যকার মনোস্তাত্ত্বিক ও শারীরিক উভয় ধরনের দ্বন্ধ চমৎকার ভাবে ফুটে উঠেছে৷ কখনো সে দ্বন্ধ হয়ে উঠে প্রত্যক্ষ কখনও পরোক্ষ৷ প্রভু উমাইয়ার ছেলে সাফওয়ান সামান্য একটা থাপ্পরে কান্না করলে,ক্রমাগত চাবুকের আঘাত সহ্য করে কান্না দমিয়ে রাখা বেলালের উদাহরণ টেনে সাফওয়ানকে সহ্যশক্তি শেখানোতে যেমন পরোক্ষ দ্বন্ধ ফুটে উঠে ঠিক তেমনি দুষ্ট সাফওয়ানকে আঘাতের অপরাধে বেলালকে চাবুকমারায় সে দ্বন্ধ হয়ে উঠে প্রত্যক্ষ৷ সেটাকে যদি ক্রিয়া ধরি, তাহলে বদরের যুদ্ধে প্রভু উমাইয়াকে ঘোড়া থেকে মাটিতে ফেলে তার বুকে বসে গলায় তলোয়ার ধরাটা হলো তার প্রতিক্রিয়া৷
– প্রাক ইসলামী যুগে মক্কার সৌন্দর্যকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে৷ রং বেরংয়ের কাপরের সামিয়ানা, বাড়ির সামনে কয়েক স্তরে রঙিন কাপরের ব্যবহার, মক্কার বাজারে মূর্তি বেচা-কেনা, কাবার সামনে মূর্তির ভয় দেখিকে মানুষকে তটস্থ করে পয়সা হাতিয়ে নেয়া, বিশাল ও বিস্তৃর্ণ মরুভূমির বুকে দাবিয়ে চলা ঘোড়ার খুড়ের শব্দ চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে৷ এসব দৃশ্যে চোখ আটকে যাবে৷
– ইসলামের মহান তিন ব্যক্তিত্বকে সরাসরি দেখানো হয়েছে৷ মহানবী(সাঃ) এর চাচা হযরত হামযা(রাঃ), প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর সিদ্দিক(রাঃ) ও হযরত আলী(রাঃ) কে৷ বদরের যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তিনজনের সম্মুখ যুদ্ধ প্রেক্ষিতে হযরত আলী(রাঃ) কে দেখানো হয়েছে৷ কাহিনীর পট পরিবর্তনে হযরত আবুবকর ও হামযা (রাঃ) এর সরাসরি হস্তক্ষেপ রয়েছে যেখানে আবু বকর (রাঃ) বেলাল(রাঃ) কে দিগুন দামে ক্রয় করে তার দৈহিক স্বাধীনতার স্বাদ দেয় এবং সে স্বাধীনতায় স্থায়ীত্ব দিতে তলোয়ার চালানোর কৌশল শেখান হামযা (রাঃ)৷ ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধকে দেখানো হয়েছে কিছুটা শৈল্পিক ভঙ্গিতে৷
-পরিচালক আয়মান জামাল প্রায় সাত বছর ধরে গবেষণা করে চরিত্র ও প্লট নির্মাণ করেন৷ বেলাল (রাঃ) এর জীবনীর সাথে যদিও কিছু কিছু জায়গায় অসঙ্গতি রয়ে গেছে তবে সেটা সিনামেটিক কারণে৷ এতে দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্তির স্বাদের চিত্রটা আরও অথেনটিক হয়ে উঠে৷
প্রথম মুক্তিপায় আজয়াল ইয়ুথ ফিল্ম ফেস্টিভেলে ২০১৫ সালে৷মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে মুক্তিদেয়া হলে এর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়৷ কেন্যিস ফিল্ম ফেস্টিভেলে বেস্ট ইন্সপাইরেশনাল অ্যানিমেশন মুভি ক্যাটাগরীতে পুরষ্কার পায়৷ কিছু পুরষ্কার ঝুলিতে ভরতে পারলেও ফিল্ম ক্রিটিক্সদের মন জয় করতে পারে নি৷ রটেন টমেটোর ক্রিটিক্স ৫৫% ফ্রেশ বললেও অডিয়েন্স বলছে ৮৫% ফ্রেশ৷ আইএমডিভি রেটিং ৮.৬ তবে মেটাস্কোর ৫৫৷ ক্রিটিক্সদের মন জয় করতে না পারলেও আমজনতার মন ঠিকই জয় করতে পেরেছে৷
ইসলামের ইতিহাস ও মহান পুরুষদের নিয়ে খুব বেশি মুভি নেই৷ যেই দু-একটা আছে পরিমানে তা অপর্যাপ্ত৷ তাদের নিয়ে সিনেমা তৈরী করতে শরীয়তে অনেক বাধা নিষেধ আছে তবে অ্যানিমেশন আকারেও যদি কিছু সিনেমা তৈরী করা যায় সেটা ভালো ই হবে৷ কারণ ইসলামের সে
ইতিহাস স্বর্ণোজ্জ্বল, চমৎকার সব মানবিক গল্পের প্লটে পূর্ণ৷
Fuad Anas Ahmed ভাইয়ের করা খুব চমৎকার একটা বাংলা সাবটাইটেল আছে৷ সেটা দিয়ে উপভোগ করলে একেবারে ১৪০০ বছর আগের ফিলিংসটা পাবেন৷
মুভি ডাউনলোড লিংক- https://bit. ly/2IBOHZX
সাব ডাউনলোড লিংক- https://bit. ly/2KxIPBu