সাদিয়া তামান্না : বাংলাদেশী মুসলমানদের ধার্মিক শ্রেনীর অধিকাংশের কাছেই ‘নারী অধিকার’ শব্দটা আতংকের। তারা প্রচলিত নোংরা নারীবাদের দোহাই দিয়ে মৌলিকভাবে ‘নারী অধিকারে’র বিষয়টাকেই এড়িয়ে যেতে চান। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছেন। তবে সমাজে এই সংকীর্ণমনাদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।
প্রচলিত নারীবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে প্রায় সবসময়ই নারীকে ইসলাম প্রদত্ত সম্মানের দোহাই দেয়া হয়। একের পর এক কোরআন হাদিসের রেফারেন্স দেয়া হয়। কিন্তু একবারও কি আমরা ভেবে দেখেছি যে,এই অধিকারের বিষয়টা কিতাবের পাতায় এবং পূর্ববর্তীদের জীবনে থাকলেও আমাদের বাস্তবজীবনে এর উপস্থিতি খুবই বিরল!
এই অঞ্চলের অন্তত গত দেড়’শ বছরের চিত্র এর নির্মম সাক্ষী। এর আগের কথা আপাতত উহ্য থাক।
আমার এই কথা শোনার পরে অনেকেই হয়তো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবেন। কিন্তু নিকট অতীতে শুধুমাত্র ধর্মীয় সেক্টরেই (অন্যান্য সেক্টরের কথা বাদই দিলাম।) ইসলামের স্বর্ন যুগে মেয়েদের যে অংশগ্রহণ ছিল তার সিকিভাগ অংশগ্রহণের নযীর কেউ দেখাতে পারবে ? দীর্ঘ শতাব্দীকাল জুড়ে ক’জন নারী মনিষা জন্ম দিতে পেরেছি আমরা ?
অথচ ইসলামের প্রথম যুগ থেকে অনেক নারী মুহাদ্দিসাহগণ পুরুষদের তা’লিম দিয়েছেন।
তা’লিম নিতে তাঁরা মাহরামদের সাথে করে এক শহর থেকে অন্য শহরে ছুটেছেন। ‘রিহলা’র ইতিহাসে তারা বড় বড় ‘সাহিবে হাদিসের’ মতোই স্বমহিমায় ভাস্বর হয়েছেন।
অথচ এইসব সত্য উচ্চারন করলে আজকাল আমাদের কপালে ‘ইসলামপন্থী ফেমিনিস্ট’ খেতাব জোটে !
আজকাল শিক্ষার জন্য মেয়েদের ঘর থেকে বের হওয়াকেই বাঁকা চোখে দেখা হচ্ছে। আর কোন স্বামীহীনা যুবতী নারীর ক্ষেত্রে সন্তানের শিক্ষার জন্য দূর দূরান্তে ‘সফর’ করাটা কল্পনা করাও আপনাদের জন্য কষ্টকর।
অথচ সে যুগের অন্য অনেক মায়ের মতো ইমাম শাফেয়ী রহঃ এর মা’ও শিশুসন্তানকে ‘মানুষ’ করতে মক্কায় ছুটে এসেছিলেন। আরেকজন মহীয়সী নারী স্বামীহীনা অবস্থায় দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে তিল তিল করে সন্তানকে গড়ে তুলেছিলেন ইসলামিক স্কলার হিসেবে। হ্যা, আমি ইমাম মালিকের উস্তাদ রবী ইবনে আব্দুর রহমানের মায়ের কথাই বলছি। ইতিহাসের ভগ্নস্তুপে এমন আরও অসংখ্য মহীয়সী নারী অমর আলোকবার্তিকা হয়ে আছেন। যাদেরকে আপনারা ভুলে যেতে বদ্ধপরিকর।
আপনারাই বলুন,এইসব রত্নগর্ভা মায়েরা কি মূর্খ ছিলেন ? ধর্ম বুঝতেননা ?
বর্তমান সমাজ পরিস্থিতি দেখলে মনে হয় এখনকার অধিকাংশ ধার্মিক (পড়ুন : তথাকথিত অতি রক্ষনশীল বকধার্মিক) ভাই বোনেরা তাঁদেরকে সামনে পেলে ফেমিনিষ্ট,জাত বিচ্যুত বলে হাহুতাশ শুরু করে দিতেন। ইসলাম গেলো রে,পর্দা গেলোরে বলে বলে পাড়া মাথায় তুলতেন।
এই যে, নারীরা ঘরের বাইরে বের হয়েছিলেন। ইসলাম কি তাতে ডুবে গিয়েছিলো?
আধা-বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো?
ধর্ষণের মহোৎসব হয়েছিল নারীরা বাইরে বের হওয়ার কারণে ? হয়নি। কারন তখনকার মেয়েরা সংযমী হওয়ার পাশাপাশি আপনাদের পুরুষদের মানসিকতাও স্বচ্ছ নির্মল ছিল। ধর্মপালনের বাস্তবচিত্র সেখান থেকেই সবার শেখা উচিত।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো আপনারা যারা দাঈ বা ধার্মিক। ধর্ম মানেন ও অন্যকে মানাতে চান তাঁরা নিজেদের পূর্বসূরীদের ব্যাপারে জ্ঞান না রেখে নিজ মনমতো ধর্ম-প্রচার করেন।
সালাফ ও আকাবীরের ধোঁয়া তুলে নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা ও ভুল চিন্তাকে সমাজের উপরে চাপিয়ে দিতে চান।
আপনি অবুঝ ব্যাকওয়ার্ড হোন,সমস্যা নেই। কিন্তু আপনার এই শতবর্ষ পুরোনো ভুল চিন্তাকে ইসলাম বলে চালিয়ে দিলে আমি অন্তত মেনে নেবোনা।
ধর্ষনের কথা যখন উঠেছেই তখন বলতে বাঁধা নেই যে,আপনাদের একটা প্রসিদ্ধ সংকীর্ণতা হচ্ছে সবকিছুতে ধর্ষনের গন্ধ খুঁজে বেড়ানো। নিজেদের সব অপরাধের প্রায়াশ্চিত্ত মেয়েদেরকে দিয়ে করানো। ধর্ষনের সমস্ত দায় তাদের উপর চাপাতে এর মোটিভ হিসেবে সবসময় তাদের কথা,কাজ আর চলাফেরাকেই শুধু চিন্হিত করা। সেই সাথে নিজেদের নগ্ন পাশবিকতাকে আড়াল করা। কিন্তু এভাবে কারও সবকিছুতে ধর্ষণ খুঁজলে তো সমস্যা। যে পরিমাণ সময় আপনারা ধর্ষণের ভূল কারণ খোঁজার মাধ্যমে ধর্ষণকে জেনে না জেনে,বুঝে না বুঝে একপ্রকার বৈধতা দিতে ব্যয় করেন। একটা ধর্ষিতা মেয়ের শাস্তির জন্য যদি এ পরিমাণ প্রতিবাদ করতেন কিংবা নিজেদের পরিচ্ছন্ন মানসিকতা গঠনের জন্য ব্যয় করতেন তবে হয়তো আর ধর্ষণ ই হতো না। ওয়াল্লাহু আ’লাম।
এছাড়া কথায় কথায় বেগম রোকেয়ার পিণ্ডি চটকানোও আপনাদের ক্ষুদ্র চিন্তার আরেকটা ‘মহান’ উদাহরন।
উপমহাদেশে বেগম রোকেয়ার সময়ে কি পরিমাণ নারী আলেমা(!) ছিলেন, শাইখা ছিলেন,কতজন ইমাম শাফেঈ’র মায়েদের মতো মা ছিলেন, কতজন নারীর আকিদাহ শুদ্ধ ছিল সেটার একটা আনুমানিক পরিসংখ্যান পারলে বের করুন।
তারপর নাহয় বেগম রোকেয়াকে দোষারোপ করবেন।
তাঁর বিশ্বাসের সাথে একমত না হোন, কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্যকে খারাপ প্রমাণ করতে, এবং নারীদের দুনিয়াবী শিক্ষা ফরজ না, ফরজ শুধু দ্বীনি শিক্ষা এসব বলার আগে তৎকালীন সময়ে দ্বীনি শিক্ষাপ্রাপ্ত শাইখাদের একটা লিস্ট দেন। পারবেন? ‘ঐসময় পর্যাপ্ত নারী শিক্ষা ছিল’ না কথাটা বললেই তো দ্বীনি শিক্ষার ধোঁয়া তুলে সবাইকে থামিয়ে দেন। তো এবার আপনারা আমাকে মেয়েদের তৎকালীন দ্বীনী শিক্ষারই একটা পরিসংখ্যান দেন। আমি কৃতজ্ঞ হই।
কোন কার্যকরী পদক্ষেপ না নিয়ে সবাই মিলে শুধু “বেগম রোকেয়া নারীদের বাইরে এনে ধর্ষণের প্রাথমিক বন্দোবস্ত করেছেন” টাইপের মুখস্থ বুলি আওড়ানোতে কি স্বার্থকতা আছে আমার জানা নেই।
এছাড়া বেগম রোকেয়ার আমলে মুসলিম মেয়েরা টপস, মিনিস্কার্ট পরে শিক্ষার্জনে বাইরে বের হতো বা তিনি অশ্লীলতাকে প্রমোট করেছেন বলেও কোন প্রমান আপনারা দেখাতে পারবেননা।(এখানে আমি পোশাকের জন্য ধর্ষণকে বৈধতা দিচ্ছি না।)
নারীরা তো বহু আগে থেকেই পর্দাসহ বাইরে ছিলেন। তখন ধর্ষণ হলো না কেন ? আপনাদের খোড়া যুক্তি অনুযায়ী তো তখনই গনহারে ধর্ষণ হওয়ার কথা। আসলে আপনারা যখন পর্দার দোহাই দিয়ে জ্ঞানচর্চাকেই অপাংক্তেয় ঘোষনা করেন তখনই মেয়েরা পর্দার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়। এই দায় সম্পূর্ণ আপনাদের।
এছাড়া আপনারা যারা আমাদের বক্তব্যের পিছনের কারণ ই শুনতে চান না। বরং উল্টো সবাই মিলে নিজেদের ব্যাখ্যা শুনাতে আসেন তাঁদেরকে আমি ইসলামের জন্য চরম ক্ষতিকর মনে করি।
এতে করে আপনারা আমাকে ফেমিনিস্ট, তথাকথিত প্রগতিবাদী, সিআইএ বা মোসাদের দালাল কিংবা আরও কিছু মনে করলেও তাতে আমার কিছু যায় আসে না।
আমি বেগম রোকেয়ার মানহাজ বা পদ্ধতির ভক্ত অনুসারী কিছুই নই। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য আমার জানামতে অবশ্যই সৎ ও প্রশংসনীয়। ‘নারীরা শিক্ষিত হবে’ এই উদ্দেশ্যে আন্দোলন করায় আমি অকুন্ঠচিত্তে তাঁর প্রশংসা করবো। আবার তার শরীয়াহ বিরোধী যেকোনো বক্তব্যের ক্ষেত্রে আমি তাঁর সাথে নির্দ্বিধায় দ্বি-মত পোষন করবো।।
আপনাদের কাছে তিনি নিন্দিত হওয়ার একমাত্র যে কারণটি দেখতে পাই তা হলো,নারীদেরকে ঘর থেকে বের করে আনা। অথচ আরবের (পড়ুন : ইসলামী খেলাফতের) নারীরা শত শত বছর আগেই শিক্ষার জন্য ঘর থেকে বের হয়েছেন। নিরবচ্ছিন্নভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধর্ম ও জ্ঞানের চর্চা করেছেন। কিন্তু তাঁদের এই উন্মুক্ত জ্ঞান চর্চায় সমাজ কলুষিত হয়নি। ধর্ষণের সয়লাব হয়নি। কিংবা দুনিয়া থেকে ইসলাম উঠে যায়নি। বরং ইসলামের ইতিহাস তাঁদের দ্বারা আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। দুনিয়ার বহু বড় বড় ইমামদের উস্তাদদের তালিকায় অসংখ্য মহীয়সী নারীর নাম পাওয়া যায়। আজকের প্রেক্ষাপটে যা কল্পনা করাও কঠিন।
জ্ঞানচর্চার এমন উন্মুক্ত পরিবেশ সত্ত্বেও সেই যুগের নারীরা তো পুরুষদের সাথে এযুগের মেয়েদের মতো ব্যবহার করেনননি। কিংবা সেই যুগের পুরুষেরাও কখনো তাদের সাথে আজকের মতো সংকীর্ণ অসংযমী আচরন করেননি। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?
সমস্যা মূলত আপনাদের মগজের মধ্যে। ক্ষুদ্র গণ্ডিবদ্ধ চিন্তার মধ্যে। সিস্টেম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আপনাদের লজ্জাজনক ব্যর্থতার মধ্যে। আপনাদের এই ব্যর্থতাই আজকের সমাজকে পশ্চিমের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছে। আপনারা আপনাদের ঘরে,সমাজে জ্ঞানচর্চার উপযুক্ত পরাবেশ তৈরী করতে পারেননি বলেই মেয়েরা আজ পশ্চিমা চিন্তার ‘শরাব’ গিলছে।
ইয়োরোপিয়ান রেনেসাঁর পরে এসব সমস্যার সমাধানের জন্য আপনারা নিজেরা,আপনাদের নিজেদের বড়রা -সালতানাত বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর থেকে যুগ যুগ ধরে- একগাদা ভূল চিন্তা ও পদ্ধতি সযত্নে লালন করছেন। সন্তান,বোন ও ভাইদেরকে উত্তরাধিকার সূত্রে সেই ভুল চিন্তায় দিক্ষিত করছেন। অশ্লীলতা ও ধর্ষণের মোটিভ খোঁজার ক্ষেত্রে একপেশে চিন্তা এবং সেই অযুহাতে নারীদেরকে পিছিয়ে রাখার চিন্তা এভাবেই উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। নামধারী অনেক ‘ত্বলেবে ইলম’ বা ‘দ্বীনী ভাই বোনের’ চিন্তা ও কথামালা আমার এই বাক্যের সত্যতা প্রমাণ করবে। অথচ যোগ্য মা তৈরী না হলে কখনোই যোগ্য প্রজন্ম গড়ে উঠবেনা। এটা আক্ষরিক অর্থেই অসম্ভব।
আপনারা বুঝতে চাননা যে,আজকের নারীবাদী আন্দোলন কোন ক্রিয়া নয় বরং প্রতিক্রিয়া। দীর্ঘকাল ধরে এতদঞ্চলে নারীদের ‘খোদাপ্রদত্ত’ অধিকার না দেয়ায় এবং হিন্দুভাবাপন্ন পরিবেশে নারীকে প্রায় দাসীর সমমর্যাদায় নামিয়ে আনার প্রতিফল। (সম্ভ্রান্ত ও বনেদী পরিবারগুলোতে অনেক ব্যতিক্রম চোখে পড়ে। কিন্তু ব্যতিক্রম কখনো দলীল হতে পারেনা।) যুগ যুগ ধরে জমানো ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে আজকের এই আগ্রাসী নারীবাদিতা। নারীর সত্যিকারের অধিকার নিশ্চিত করা ছাড়া এই আগ্রাসী তাণ্ডব বন্ধ করার দ্বিতীয় কোন পদ্ধতি আমার জানা নেই।
আমার প্রায়ই মনে হয় আপনারা -এই সমাজের হর্তাকর্তারা- আসলে সমস্যার স্বরুপ নিরূপনেই ব্যর্থ। আপনারা আমাদের অধিকার দিতে ভয় পান। কারন এর পেছনে আপনারা সবসময় পশ্চিমা জুজুর ছায়া দেখেন। তাদের সমাজের ভয়ংকর চিত্রগুলো আপনাদেরকে তাড়িত করে। তাই মাথাব্যথার সহজ(!)সমাধান হিসেবে ‘মাথা কেটে ফেলার’ মতো ‘নোংরা নারীবাদ’কে রুখতে গিয়ে মৌলিক ‘নারী অধিকারেরই’ গলা টিপে ধরেন।
মনে রাখবেন,নারীর ধর্ম প্রদত্ত স্বাধীনতা ও অধিকার নিশ্চিত করতে কোন ঝুকি নেই। থাকতে পারেনা। কারন এটা আল্লাহ কর্তৃক অনুমোদিত। হ্যাঁ, কোন জায়গায়,সমাজে বা পরিবেশে এটা বাস্তবায়নের পদ্ধতি শরীয়ত সম্মত না হলে সেটা অবশ্যই বর্জনীয়। তাই স্রোতের বিরুদ্ধে দাড়িয়ে আপনি মেথড পরিবর্তনের কথা বলতে পারেন। সিস্টেমেটিক বিপ্লবের কথা বলতে পারেন। কিন্তু প্রচলিত ভূল মেথডের দোহাই দিয়ে কারও অধিকার কেড়ে নিতে পারেননা। কাউকে পিঞ্জিরাবদ্ধ করে কল্পিত স্বাধীনতার হাওয়াই মিঠাই খাওয়াতে পারেননা। এটা স্পষ্ট অন্যায়। এর প্রতিফল কখনো ভালো হতে পারেনা।
আল্লাহ সবাইকে শুভবুদ্ধি দিন। বুদ্ধিবৃত্তিক অন্ধত্ব ও বন্ধ্যাত্ব থেকে রক্ষা করুন।