শেষের কবিতা
দেখো যতি, মানুষের কোনো কথাটাই সোজা নয়। আমরা ডিক্শনারিতে যে কথার এক মানে বেঁধে দিই, মানবজীবনের মধ্যে মানেটা সাতখানা হয়ে যায়, সমুদ্রের কাছে এসে গঙ্গার মতো। যে ভালোবাসা ব্যাপ্তভাবে আকাশে মুক্ত থাকে, অন্তরের মধ্যে সে দেয় সঙ্গ; যে ভালোবাসা বিশেষভাবে প্রতিদিনের সব-কিছুতে যুক্ত হয়ে থাকে, সংসারে সে দেয় আসঙ্গ। দুটোই আমি চাই।
অমিত রায় ব্যারিস্টার৷ ইংরেজি ছাঁদে রায় পদবী “রয়” ও “রে” রূপান্তর যখন ধারণ করলে তখন তার শ্রী গেলো ঘুচে কিন্তু সংখ্যা হলো বৃদ্ধি। এই কারণে, নামের অসামান্যতা প্রমাণ করে অমিত এমন একটি বানান বানালে যাতে তার ইংরেজ বন্ধু ও বন্ধুনীদের মুখে তার উচ্চারণ দাঁড়িয়ে গেলো – “অমিট রায়ে”।
একদিন ওদের বালিগঞ্জের এক সাহিত্যসভায় রবী ঠাকুরের কবিতা ছিল আলোচ্য বিষয়। অমিতের জীবনে এই সে প্রথম সভাপতি হতে রাজি হয়েছিল। গিয়েছিল মনে মনে যুদ্ধ সাজ পড়ে। তার কারন রবি ঠাকুরের প্রতি তার অনুরাগ নয়, বিরাগ। নিবারন চক্রবর্তী ছদ্মনামে নিজেরই কবিতা পাঠ করে সে প্রমাণ করে দিয়েছিল সাহিত্য ক্ষেত্রে রবি ঠাকুর নিতান্তই কীটানুকীটতুল্য মাত্র। রবি ঠাকুরের দল সেদিন চুপ করে গেল। শাসিয়ে গেল লিখে জবাব দেবে।
লাবন্যের বাবা অবনীশ দত্ত এক পশ্চিমী কলেজের অধ্যক্ষ। মা হারা মেয়েটিকে তিনি নিজের লাইব্রেরীর চেয়েও বেশি ভালবাসতেন। তার আরো একটি স্নেহের পাত্র ছিল। তার নাম শোভন লাল। শোভন আসতো তার বাড়িত্র পড়া নিতে। তার লাইব্রেরিতে ছিল তার অবাধ সঞ্চরণ। লাবন্যকে দেখলে সে সংকোচে নত হয়ে যেত।
এমন সময় একদিন শোভন লালের বাবা ননীগোপাল অবনীশের বাড়িতে চড়াও হয়ে তাকে খুব একচোট গাল পেড়ে গেল। নালিশ এই যে, অবনীশ নিজের ঘরে অধ্যাপনার ছুতোয় বিবাহের ছেলে ধরার ফাঁদ পেতেছে। এরপরো অবনীশ শোভনলালকে তার লাইব্রেরি তে আসতে মানা করেন নি। কিন্তু মানা করল লাবন্য। সম্মানের দোহাই দিয়ে সে শোভনলালকে তার বাড়িতে আর আসতে না বললে। শোভনলাল বিনা তর্কে বিনা উত্তরে লাবন্যর কথা মেনে নিল
অমিতের জীবনে অবশ্য একজন মেয়ের ছায়া ছিল। তার নাম ছিল কেতকী মিত্তির। অবশ্য বন্ধুমহলে ইংরেজি ছাঁচে তার নাম ছিল কেটি মিত্তির। বহু বছর আগে একবার প্রবল আবেগের ডাক অগ্রাহ্য করতে না পেরে অমিত স্বেচ্ছায় কেটিকে আংটি পরিয়ে দিয়েছিলো, অমিতের জীবনে ভালোবাসা কিংবা রোমান্টিকতা, যাই বলা হোক, অভিজ্ঞতা বলতে এতটুকুই।
ওদিকে লাবন্যের মনেও যে শোভনলালের প্রতি দুর্বলতা ছিল না তা না। শোভনলালের সাথে বিচ্ছেদের পর কিছুটা একাকী সময় কাটানোর জন্য একই সাথে হাওয়া বদলের জন্য লাবন্য পাড়ি দিল শিলং এ, তার কর্তা-মা যোগমায়ার বাড়ি।
বিয়ে করার জন্য বোনদের চাপে অমিতের জীবন ক্রমশই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো। একটু নির্জনবাসের তিতিক্ষা ক্রমশই তার মনে বুভুক্ষুর মত হানা দিচ্ছিলো। তাই অমিতও বেছে বেছে শিলং পাহাড়ে গেল। তার একটা কারন ওখানে কন্যা দায়ের বন্যা তেমন প্রবল নয়। অমিত সবাইকে বলে গিয়েছিল সে শিলং এ যাচ্ছে নির্জনতা ভোগের জন্য। দুদিন না যেতেই বুঝলে জনতা না থাকলে নির্জনতার স্বাদ মরে যায়।
যাহোক, একঘেয়েমি কাটানোর জন্য একদিন গাড়ি নিয়ে বের হতেই ঘটলো অপঘাত৷ তাকে নিয়তির অপঘাতও বলা চলে। সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্যক্রমে অপর একটি গাড়ির সঙ্গে তার গাড়ির সরাসরি সংঘর্ষ হল। সেই গাড়ির চালিকা আর কেউ নয়, লাবন্য। বিধাতার মনে কি ছিলো কে জানে। অপঘাত থেকে পরিচয়, অতঃপর ঘনিষ্ঠতা।
পরিচয়ের দোহাই দিয়ে যোগমায়ার বাড়িতে যাতায়াতটাও অমিতের শিলং জীবনের একটা অংশ হয়ে উঠল। লাবন্যের এই হঠাৎ পরিচিত ব্যাক্তিটিকে যোগমায়ারও খুব একটা খারাপ লাগলো না। অবসরে দুজনের জুটিটা কেমন হবে তা চিন্তা করে যোগমায়া নিজের অজান্তেই পুলকিত হয়ে উঠত।
পরিচয়ের দোহাই দিয়ে যোগমায়ার বাড়িতে যাতায়াতটাও অমিতের শিলং জীবনের একটা অংশ হয়ে উঠল। লাবন্যের এই হঠাৎ পরিচিত ব্যাক্তিটিকে যোগমায়ারও খুব একটা খারাপ লাগলো না। অবসরে দুজনের জুটিটা কেমন হবে তা চিন্তা করে যোগমায়া নিজের অজান্তেই পুলকিত হয়ে উঠত।
বিবাহের প্রস্তুতি হিসেবে লাবন্যের আঙুলে আংটি পড়ানোর সময়েও অমিতের কেতকীর কথা মনে হয়নি। এক অদ্ভুত মুগ্ধতায় লাবন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে অমিতের হৃদয় সাগরের ফেনিল শুভ্রতার মত অপার্থিব আনন্দে পরিপূর্ণ ছিল।
গোড়ায় সবাই ঠিক করে রেখেছিলো, অমিত দিন পনেরোর মধ্যে কলকাতায় ফিরবে। অথচ একমাস যায়, দু মাস যায়, অমিতের ফেরবার নামও নেই। কিসের টানে এতদিন কলকাতা থেকে অমিত বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে জানার জন্য অমিতের দুই বোন ব্যাকুলভাবে শিলং যাত্রা করলো। তাদের সঙ্গী হিসেবে ছিলো তাদেরই বান্ধবী, কেটি মিত্তির, ওরফে, কেতকী মিত্তির। লাবণ্যের প্রতি কেটির প্রথম দৃষ্টিই ছিলো অবজ্ঞার, হাজার হোক, লাবণ্য তো আর আধুনিক নয়
অমিতের বোন আর তাদের বান্ধবীর প্রতি যোগ্মায়ার দৃষ্টিটাও খুব একটা প্রসন্ন ছিল না।যোগ্মায়ার মনে শাশ্বত বাঙালি তরুণীর যে রূপটি ছিলো, এমন সিগারেট খাওয়া ইংরেজ-বাঙালীর সংকর মেয়েদের সাথে সেই রূপটি ঠিক যেন মেলে না। তবুও আতিথেয়তার খাতিরে যদ্দূর সম্ভব মিষ্টি করে কথা বলার দরকার, যোগমায়া ঠিক তদ্দূরই চেষ্টা করেছিলো।
ঠিক সেই সময়টাতে অমিত এসে উপস্থিত। মেয়েরা তো অবাক। কলিকাতা থেকে যখন সে এসেছিলো, মাথায় ছিল ফেল্ট্ হ্যাট্, গায়ে ছিল বিলিতি কোর্তা। এখানে দেখা যাচ্ছে পরনে তার ধুতি আর শাল।
বোনেদের, বিশেষত বোনের বান্ধবীকে যোগমায়ার বাসায় দেখে অমিতের খুব একটা ভাবান্তর হলো না। বরং হাসিমুখে নিজের বিয়ের কথাটা পাড়লে কেটির মুখে সামান্য ভাবান্তর দেখা গেলো। তা আরও প্রবল হলো, যখন লাবণ্যর হাতে পরানো অমিতের আংটিটা তার দৃষ্টিগোচর হলো। কেটি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না৷ নিজের অনামিকায় বহু বছর আগে অমিত ভালোবাসার নামে যে আংটি পরিয়ে দিয়েছিলো, তা খুলে অমিতের হাতেই আবার ধরিয়ে দিয়ে লজ্জায় অপমানে কেটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো
একটি ছোটো চিঠি এল লাবণ্যর হাতে, শোভনলালের লেখা :
শিলঙে কাল রাত্রে এসেছি। যদি দেখা করতে অনুমতি দাও তবে দেখতে যাব। না যদি দাও কালই ফিরব।
তোমার কাছে শাস্তি পেয়েছি, কিন্তু কবে কী অপরাধ করেছি আজ পর্যন্ত স্পষ্ট করে বুঝতে পারি না। আজ এসেছি
তোমার কাছে সেই কথাটি শোনবার জন্যে নইলে মনে শান্তি পাই নে। ভয় কোরো না। আমার আর কোনো প্রার্থনা নেই।
লাবণ্যর চোখ জলে ভরে এল। মুছে ফেললে। চুপ করে বসে ফিরে তাকিয়ে রইল নিজের অতীতের দিকে।
লাবণ্য আস্তে আস্তে বললে, “একদিন একজনকে যে আংটি পরিয়েছিলে, আমাকে দিয়ে আজ সে আংটি খোলালে কেন?”
অমিত বললে, “তোমাকে সব কথা বোঝাবো কেমন করে বন্যা? সেদিন যাকে আংটি পরিয়েছিলুম, আর আজ যে সে আংটি খুলে দিলে, তারা দুজনে কি একই মানুষ?”
তার পরে লাবণ্য অমিতের বুকে মাথা রেখে বললে, “একটা কথা তোমাকে বলি মিতা, আর কোনোদিন বলব না। তোমার সঙ্গে আমার যে অন্তরের সম্বন্ধ তা নিয়ে তোমার লেশমাত্র দায় নেই। আমি রাগ করে বলছি নে, আমার সমস্ত ভালোবাসা দিয়েই বলছি, আমাকে তুমি আংটি দিয়ো না, কোনো চিহ্ন রাখবার কিছু দরকার নেই। আমার প্রেম থাক্ নিরঞ্জন; বাইরের রেখা, বাইরের ছায়া তাতে পড়বে না।”
এই বলে নিজের আঙুলের থেকে আংটি খুলে অমিতের আঙুলে আস্তে আস্তে পরিয়ে দিলে। অমিত তাতে কোনো বাধা দিলে না।
সাত দিন যেতেই অমিত ফিরে যোগমায়ার সেই বাসায় গেল। ঘর বন্ধ, সবাই চলে গেছে। কোথায় গেছে তার কোনো ঠিকানা রেখে যায় নি।
সমস্ত শিলঙ পাহাড়ের শ্রী আজ চলে গেছে। অমিত কোথাও আর সান্ত্বনা পেল না।
লাবণ্যর মনে মনে বললে, শোভনলাল,
তুমি আমার সকলের বড়ো বন্ধু। এ বন্ধুত্বের পুরো দাম দিতে পারি এমন ধন আজ আমার হাতে নেই। তুমি কোনোদিন দাম চাও নি; আজও, তোমার যা দেবার জিনিস তাই দিতে এসেছ কিছুই দাবি না করে। চাই নে বলে
ফিরিয়ে দিতে পারি এমন শক্তি নেই আমার, এমন অহংকারও নেই।
হয়ত লাবণ্য অমিতের সাথেই ভালো থাকতো, হয়ত না। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত সে শোভনলালের কাছেই ফিরে গেলে, কেন, বিধাতাই জানেন।
অমিতের নিজের ভাষায়, “এবার আমার নিজের কথাটা স্পষ্ট করেই না-হয় বলি। রূপক দিয়েই বলতে হবে, নইলে এ-সব কথার রূপ চলে যায়– কথাগুলো লজ্জিত হয়ে ওঠে। কেতকীর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ভালোবাসারই, কিন্তু সে যেন ঘড়ায়-তোলা জল– প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্যর সঙ্গে আমার যে ভালোবাসা সে রইল দিঘি, সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে। হ্যাঁ, শ্রীমতী কেতকী সবই জানেন। সম্পূর্ণ বোঝেন কি না বলতে পারি নে। কিন্তু সমস্ত জীবন দিয়ে এইটেই তাঁকে বোঝাব যে, তাঁকে কোথাও ফাঁকি দিচ্ছি নে। এও তাঁকে বুঝতে হবে যে, লাবণ্যর কাছে তিনি ঋণী।”
“একদিন আমার সমস্ত ডানা মেলে পেয়েছিলুম আমার ওড়ার আকাশ; আজ আমি পেয়েছি আমার ছোটো বাসা, ডানা গুটিয়ে বসেছি। কিন্তু আমার আকাশও রইল।”
আয়োজন – Sumit Biswas Ovi
চরিত্র-
লাবণ্য- Farjana Prodhan
অমিত- Soumitra Dipto
কেতকী- Mira Sadia
শোভনলাল- Johan Jakariya
যোগমায়া- Arifa Jesmin Rumi
অবনীশ দত্ত- Anik Saha
Post Process- Joyonto Joy
Speical Thanks to Prasanta Bhattacharjee,Taorem Ratul Singha,Shanara Shanu,Bijoyonto Joy,শুভ তূর্য,Aviram Das Avi
শেখ মাহমুদ ইসলাম মিজু