কালো? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ।
কৃষ্ণ কলি আমি তারে বলি
জন্মে দেখেছি ঘরের দেয়াল, আসবাব, বিছানা-চাদর সবই রঙিন। শুধু রঙ নেই স্বজনদের চোখে, আমার কৃষ্ণবর্ণ কালো করে দিয়েছে তাদের মুখ।
আর তাদের কড়া দীর্ঘশ্বাস আমার নি:শ্বাসকে করে দিয়েছিল অকাল শ্রাবণের মতো অন্ধকার, যে-শ্রাবণের জলে উৎসব ভাসেনা।
আমার ছায়ারঙের বিকেলগুলি যেন আকাশকে দেখিয়ে দিত, সাদার ভেতর আছে সবক’টি রঙ।
নিজের রঙে মাতাল হওয়া চোখ সে রঙ খুঁজে পায়না। আমার কালো দুটি চোখ অজস্র রঙে এঁকে গেছে পৃথিবীর রঙ, উড়ন্ত বাতাসে আমি এক বহুবর্ণ আনন্দকন্যা!
বয়স বেড়ে গেলে সব মেয়েই বন্দী হয় সময়ের খাঁচায়। রূপের মোহে যে পাখি দেয়ালবন্দী হয়, তার চোখে কি আর আলো ফুটে?
দেয়ালজুড়ে এলিয়ে যাওয়া মেয়ের ছায়া তো কালোই দেখায়, হোক সে যতোই রূপালী।
আমাদের ছাদে পরপর প্রেমপত্র আসত। নিজেকে জিজ্ঞেস করতাম, তোর এতো প্রেমিক কী রে কালো মেয়ে?
আসলে প্রেমপত্র এক আদিম বিজ্ঞাপনী ধারণা, যেখানে বিজ্ঞাপন যেকোনোভাবে পৌঁছে যায় প্রত্যেক ছাদে!
যার বিজ্ঞাপন যত ভাল, সে পাবে ততো চমৎকার উত্তর!
আমার আকাশেও মেঘের ফাঁকে সূর্য দৃষ্টি ফেলল। সূর্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমিও সমর্পণ করলাম নিজেকে। আমার প্রতিবিম্বে দাঁড়িয়ে রবি যেন গ্রাস করল আমাকে, পেছনের সব কালো মুহূর্তে পালিয়ে গেল। আমাকে প্রদক্ষিণ করল দিবাকর, গ্রহণ শেষে আমি হলাম চন্দ্রাবতী।
চাঁদের নিজস্ব কোনো রঙ নেই, সূর্য এসে পেছনে দাঁড়ালেই সে হয় রূপালী। মানুষের ত্বকেও সূর্যের আলোর প্রতিফলনকেই দেখায় উজ্জ্বল।
অত:পর আমার আকাশে যখন সূর্য এলো, একই আমি এবার বসুন্ধরায় ছড়িয়ে দিলাম আমার রঙ। আমার অমাবস্যা জীবন, রবির রঙে পূর্ণিমা নামিয়ে দিল অস্ফূট হাসিতে।
পূর্ণিমার পর পর্যায়ক্রমে অমাবস্যা আসে। আমার বেলায়ও আসল। সূর্য তখন অন্য গোলার্ধের মোহে আচ্ছন্ন।
দিগন্তময় আলোর মাঝখানেও আমি অন্ধকারে পড়ে রইলাম।
আমার দু’টি ছায়া হেলান দিয়ে বসল আমার দেয়ালে ঠেকানো পিঠে।
মাটির উপর হাজারো রাস্তা, তবু যেন তারা অন্ধকার বাতাসে ঝুলন্ত অজানা এক রাস্তার দিকে হেঁটে যেতেই বেশি উৎসাহী।
প্রত্যেকের দৃষ্টিজুড়ে থাকে বিকল্প সমাধান। আকাশে যদি অনুজ্জ্বল কোনো নক্ষত্র চোখের সামনে পড়ে, তবু তা পাশ কাটিয়ে দূরের নক্ষত্রটির দিকেই চোখ যায়। আর আমাকে আবারও ঢেকে দিল মেঘ, উজ্জ্বল তারাদের মাঝখানে আমি বড্ড বেমানান, অপ্রয়োজনীয়।
চোখের কিনারে আলো-জ্বালা এতো এতো তারা, মেঘ সরিয়ে কে আমাকে খুঁজতে চাইবে?
আমার কপালে ভাগ্য নয়, লেখা ছিল এক বিশাল সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ড দেখেই সবাই বিচার করত সব গুণাগুণ।
আমার চারপাশের সবাই অতি যত্নে সেই সাইনবোর্ড লিখে দিয়েছে, এতোই শক্ত ছিল এর অবস্থান যে আমার তা তুলে ফেলার ক্ষমতা ছিলনা।
এক অদৃশ্য স্রোত আমাকে প্রতিনিয়ত টেনে নিতে চাইত।
আমি আমার নিজস্বতাকে কখনো সেই স্রোতে হারিয়ে ফেলতে চাইনি।
কিন্তু সময়ের স্রোতে ডুব না দিয়ে নিজেকে ধুয়ে ফেলার কোনো উপায় ছিলনা।
স্রোতের বিপরীতে পার হওয়ার শক্তি ছিলনা আমার, স্রোতে ভেসেই আমাকে যেতে হবে ওইপারে।
আমাকে আমি দেখতে শিখেছিলাম অন্যদের চোখ দিয়ে। আমার চারপাশ আমাকে যেরকম দেখিয়েছে, আমিও সেভাবে দেখেছি আমাকে।
অথচ জলের কাছে আসতেই আমি আমাকে দেখলাম অবিকল আমার মতো। কেবল জলই দেখলাম স্থির হয়ে অসীম আকর্ষণে দেখছে আমাকে!
কারো ক্ষমতা ছিলনা আমাকে আপন করে নেয়ার।
আমার ছিল হাজারো প্রশ্ন।
কে আমার সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে?
শেষমেষ ভেবে পেলাম, দেখতে যে আমার মতো, সে-ই বুঝবে আমার বেদনা।
অন্ধকার আর আমার একই রূপ ছিল, তবে আলো ফেললে অন্ধকার পালিয়ে যেত।
মৃত্যুও কালো, আর তার পালিয়ে যাওয়ারও ভয় নেই।
মেইন ফেস : তাসমিয়া কানিজ আহমেদ
Special Appearance- Rony Ray, Mou Priya
ক্যাপশন : অপরুপ দাস অয়ন
বিশেষ ধন্যবাদ : জয়ন্ত জয় ও তনু দীপ
ফটোগ্রাফি : Sumit Biswas Ovi
শেখ মাহমুদুল ইসলাম মিজু
সম্পাদক, অক্ষর বিডি