দশম পর্ব: পথে জনমানুষের কোন চিহ্ন নেই। সচরাচর ঢাকা শহরে হরতাল অবরোধ ছাড়া এমনটা কখনো দেখা যায়না। কয়েকটা কাক আজ রাজপথের পথচারী। একটা আগুনজ্বলা চুরুট হাতে অনেকদিন বাদে একাকী হাঁটছে সাজু গুন্ডা। অন্যসময় চারপাশ জুড়ে তার দলবল লেগে থাকে। এলাকার বড় ভাই বলে কথা।আজ বিকেল থেকে মাথার ভেতর কি যেন ভৌঁ করে দৌড় দিচ্ছে। অসম্ভব যন্ত্রণা হয় তখন। একটু থেমে আবার দৌড় দেয়।আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারেনা সে।সন্ধে নাগাদ মাথার যন্ত্রণা’টা অসহনীয় পর্যায় এসে ঠেকেছে।দু’হাতে মাথা চেপে ধরে অসহ্য ব্যাথায় বার বার কুকড়ে যাচ্ছে সাজু। সামান্য একটু আওয়াজ যেন ব্যাথাকে আরো তীব্র করে নিয়ে আসে।পুরো পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রণা একসঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে মাথার মগজে। কেমন যেন মনে হচ্ছে ব্যাথা আর যন্ত্রণা এক নয়।ব্যাথার চেয়ে হাজার গুন বেশী কষ্ট আর অসহ্যের হয় যন্ত্রণা। মাথার তালু ছেড়ে ভেতরের মগজ যেন কিসে খুবলে খাচ্ছে বারবার।
ঘর ছেড়ে বারান্দায় এসে বসে সাজু। সামনে বিদেশী রাম আর হুইস্কির মেটে রঙে পানির মদের বোতল সাজানো। রুমের সব আলো নিভিয়ে দিয়ে সব্বাইকে চলে যেতে বলে সাজু।
বডিগার্ড সুমনের মনে ব্যাপারটা ধাক্কা খায়।
এমনতো কখনো হয় নাই!
“সাজু ভাইর আইজ হইলোডা কি”
কাছে এসে জিজ্ঞেস করতেই সাজু বলে মাথাডা বড় বেদনা করতাছেরে ‘সুমন’। মনডায়ও কেমন সায় দিতাছেনা।
সুমন কাছে এসে আস্তে করে বলে “ভাই ডাক্তার ডাকুম’
সাজু হাত নেড়ে জবাব দেয়।
না! তার দরকার নাই।
তোরা যা উপরে যা।আমারে একলা থাকতে দে,আর শোন নতুন জিনিসটায় বিচি ভইরা আমার এহেনে দিয়া যা।
এমপির কাছ থেকে উপহার পাওয়া নতুন রিভলভার।গতমাসে এমপির নির্দেশে একটা নিরীহ পরিবারের চারজনকে একসঙ্গে কুপিয়ে মারার ফলস্বরুপ এটা। ছয় রাউন্ড গুলি পূর্ণ করে সামনে রেখে চলে যায় সুমন।আকন্ঠ মদে ডুব দেয় সাজু।ঢকঢক করে একবোতল শেষ করে নিমিষেই।মাথার যন্ত্রটা আস্তে আস্তে কমে আসে। বড় শান্তি বোধহয় সাজুর। চোখ ঝিমঝিম করে।টেনে মেলার শক্তিটুকুও নেই। গেলাসের পর গেলাস গিলে আরেকটা বোতলও শেষ।কেমন নিঃসাড় মনে হয় চারদিক। সাজু হাসে।শরীর কেমন পাতলা হয়ে কোথাও চলে যেতে চায়।কি সব আজে বাজে পুরনো মৃত্যুর ছবি ভীড় করে চোঁখের পাতায়।সাজু দু’হাত উঠিয়ে চোঁখের সামনে থেকে ওগুলো সরাবার চেষ্টা করে। আবার আসে আবার সরায়। সাজু পিস্তল হাতে নিয়ে রাস্তায় বেরুয়।নেশার ঘোরে উল্টাপাল্টা বকেই যাচ্ছে। কই কোন শালা আমারে ভয় দেহাছ! আয়! আয় দিহি সামনে আয়। রাত গভীর। পুরো রাস্তা জুড়ে শুধু অন্ধকারটুকু। এতরাতেও কয়েকটা কাক যেন পথের মাঝে দাঁড়িয়ে।ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ওগুলোকে কেমন হলুদ হলুদ মনে হচ্ছে। সাজু টলতে টলতে হাঁটে। পিস্তল কোমড়ে গুজে হঠাৎ একটা ছায়া ধরতে যায় সাজু। বিশাল এক লড়ি রাস্তার মাঝখান ধরে এগিয়ে আসছে। ওটার ছায়াই দূর থেকে সাজুকে টেনে আনে। রাতের মাঝভাগ।পুরো রোড ফাঁকা। ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসছে লড়ি।তারচেয়েও জোরে ছুটেছে সাজু। হঠাৎ দৌড়ে সামনে এসে পড়ায় ড্রাইভার একটুও দেখেনি সাজু’কে। পিচঢালা রাস্তায় একদম পিশে গেছে সাজুর শরীর।শহরের সবচেয়ে বড় খুনীর মৃত্যু হয়ে গেল অন্ধকারের শরীরে। শতশত নিরীহ প্রাণের আত্মাখেঁকো পশুর এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। ধর্ষিতা আত্নাগুলো নিয়ন আলোয় একরাশ আনন্দ করে বিদায় হয়ে গেল।বেচে থাকতে পাষন্ডের মত অত্যাচার করে এসকল নিরীহ মেয়ে গুলোর দেহ ছিড়েছিল সাজু।
মুখের একপাশ দেখে অনেক কষ্ট আঁচ করা যায় এটা সাজু গুন্ডার লাশ। ভোরে ভিক্ষার বাটী নিয়ে বেরুবার সময় নছিমন বিবির চোঁখে পড়ে সাজুর লাশ। ওয়াক থু করে একদলা থুথু দেয় লাশের গায়ে। বুড়ো নছিমনের চোঁখে ভেসে ওঠে তার ছেলে নবাবের মুখ। এগারো বছর আগে নিজের ছেলকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে মারে সাজু। এ এলাকার মোড়ে সাজুর যে প্রাইভেট কারের গ্যারেজ ওটা নছিমনের ছিল।জোড় করে দখল করতে গেলে নবাব থানায় মামলা করে। এতে সাজু ক্ষেপে গিয়ে রাস্তায় নছিমনের সামনেই নবাবকে মেরে ফেলে। ঐ জায়গাটুকু আর নবাব ছাড়া আর কিচ্ছুটি নেই নছিমনের। সব খোয়া গেলে সেদিন কোন কথা বলতে পারেনি নছিমন। একটু আওয়াজও বের হয়নি তার গলা ভেঙ্গে। ফ্যালফ্যাল করে শুধু নবাবের মৃত মুখে তাকিয়ে ছিল নছিমন বিবি। সমাজের লোকেরাই নবাবের দাফন কাফন সম্পন্ন করে। ছেলের এ নৃশংস মৃত্যু দেখে নছিমন পাগল হয়ে গিয়েছিল। সারাদিন বিড়বিড় করে পুরো এলাকা ঘুরে সন্ধেবেলা রাস্তার এখানে এসে নবাবের নাম করে আগরবাতি জ্বালায় সে।
আজ এগারো বছরের জমানো বাশি থুথুটুকু ঢেলে দেয় সাজু গুন্ডার মুখে। একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর হনহন করে সামনে চলে যায় নছিমন বিবি। বিড়বিড় করে বলতে থাকে কাওয়া মরছেরে কাওয়া মরছে।
চারপাশ মানুষে গিজগিজ করছে। একটু পা ফেলার জায়গা নেই কোথাও।শহরের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী সাজু গুন্ডা রাতে গাড়ী চাপায় মারা গেছে। দূর থেকে মানুষ একনজর দেখতে আসে তাকে। সবাই দেখে যায়।অথচ কারো চোঁখে সহানুভূতির চিহ্ন টুকু নেই। আহা! শব্দের কোন আওয়াজ বের হয়না কারো স্বর থেকে। মনে মনে খুশী শহরের মানুষ। পুলিশী ব্যারিকেড দেয়া রাস্তার মাঝখান জুড়ে। পোস্টমর্টেমের জন্য সাজুকে মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
পেছন দিকে কোথ্থকে নছিমন বিবি যেন আবার এসে হাজির।বিড়বিড় করে হাসে আর আওড়িয়ে যায় কাউয়া মরছেরে কাউয়া মরছে।
প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে মানুষকে দিনরাত অত্যাচার করে জীবন কাটিয়ে গেছে সাজু। দিনের পর দিন সমাজে ছড়িয়ে গেছে ত্রাস। সমাজের সবখানে তার অত্যাচার।
অথচ! এ কেমন জীবন কাটিয়ে গেল। তার মৃত্যুর পর প্রত্যেকটা মানুষ শান্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। কোন একটা মন থেকে তার জন্য একবিন্দু বেদনাবাক্যটা পর্যন্ত বের হলোনা। এমনটাই হওয়ার কথা অদৃষ্টে। যারা পৃথিবীতে এরকম অত্যাচার করে দাপিয়ে বেড়ায় তাদের শেষের পরেরটা এমনি হবে নিশ্চিত। পৃথিবীর মানুষ তাদের মৃত্যুতে শোকগাথার পরিবর্তে মৌন আনন্দ মিছিল করে বেড়ায়।