৬
আলিমুদ্দিন সাহেব একজন লয়ার।
.
আজ মামলার শেষ শুনানি। জজসাহেব হয় ত রায়ও শুনিয়ে দিবেন।
এমনিতে জজসাহেব আলিমুদ্দিনের উপর বেশ ত্যাক্ত আছেন। সাক্ষপ্রমানের অভাবে তিনি শুধু মামলাটা প্যাঁচিয়ে গেছেন। এতে করে বহু নেতা ও গুণি ব্যাক্তির সময় নষ্ট হয়েছে।
লাগাতার একমাস লোকটির পক্ষে মামলা চালিয়ে তিনি এই মামলার একটা ছায়াপথও খুঁজে পেলেন না। তার ভেতরে, মামলাটা এখন সরকার হ্যান্ডেল করছে। দশদিন আগেও এটা একটা সাধারণ পুলিশিমামলা ছিল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে চা শেষে সিগারেটের ছাই এ্যাশট্রের মুখে ফেলতে ফেলতে এসব কথা ভাবছিলেন- তিনি। আজকে একবার কথা বলে নেয়া উচিত- এই ভেবে উঠতে যাচ্ছিলেন, রোকেয়া সামনে এল, কাপ হাতে- ‘চা টা খেয়ে যাও!’
রোকেয়া বেশ ক’দিন টের পাচ্ছে, তার স্বামী এখন মামলা নিয়ে সিরিয়াস ব্যস্ত। এরম সিরিয়াস হয়ে গেলে- সে তাকে অত ঘাটায়না। বহুদিন পর হয় তো, জিগ্গেস করে- ‘তোমার মামলার হালচাল কী উকিল সাহেব?’
এমনিতে রোকেয়া শশুড়বাড়ি বিজেতা একজন অসাধারণ মহিলা। পুরো বাড়ি জুড়ে তার নামে জিকির চলে।
– ‘নাহ্, খাব না!’
– ‘তুমি কি খুব ব্যস্ত?’
– ‘হুম, তবে আজ বিকেলের খাবার আমরা সবাই বাইরে খাব। টুকু আর তপুকেও রেডি রেখ!’
– ‘ওমা! এজ এ একজন উকিল মানুষ- আই মিন তুমি, ব্যস্ত হবার পর কবে থেকে বাইরে খাবারের প্ল্যান শুরু করলে?’
– ‘হুর, তেমন কিছু না। ব্যস্ আজকে বিকেলের খাবারটা আমরা বাইরেই খাচ্ছি। ওকে?
আলিমুদ্দিন সাহেব রোকেয়াকে আর কথা বলার সুযোগ দিলনা। কালোকোটটা হাতের বাহুতে ঝুলিয়ে, গফগফ্ হেটে তিনি বাইরে চলে গেলেন।
দুুুপুর একটা পাঁচ বাজে। পুরো রাস্তাঘাট থমথম্। একটা কাকপক্ষীও নেই। নেতা সামাদের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পরদিন থেকে পুরো এলাকায় এখন কার্ফিও চলছে।
মোড়ে কয়েকটা টঙ দোকান খোলা আছে। দোকান গুলো দখল করেছে কয়েক পিকাপ পুলিশ। কেউ চা খাচ্ছে, কেউ হাসি ঠাট্টা করছে। কিছুদূর হাঁটার পর একটা রিকশা দেখা গেল। আলিমুদ্দিন সাহেব ডাক দিলেন- ‘এ্যাই রিকশা!’
রিকশা তার সামনে এসে দাড়াতেই হঠাৎ গলির মোড় থেকে একটা বিকট স্লোগান সহকারে মিছিল বেরিয়ে এল।
আলিমুদ্দিন সাহেব তাড়াতাড়ি রিকশায় উঠে পড়লেন। দরদামও করলেননা।
‘মামা কই যাবেন?’- পেডেল মেরে বললেন রিকশাওয়ালা।
‘হাইকোর্টের দিকে যাও!’- আলিমুদ্দিন সাহেব খুব স্পিড়ে বললেন। তার গতিবেগের সাথে তাল মিলিয়ে রিকশাটাও বিমানের মত ছুটছে।
মিছিলটা বহুদূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। তাদের স্লোগান হালকা শোনা যাচ্ছে। আলিমুদ্দিন সাহেব শোনার চেষ্টা করলেন-
“ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই
নেতা হত্যার ফাঁসি চাই
প্রশাসনের জবাব চাই”
আলিমুদ্দিন সাহেব একটা হাসি দিলেন।
৭
রিকশা হাইকোর্টে থামতেই দুই গ্রুফের মারামারি ধাওয়া পাল্টা দেখা গেল।
আলিমুদ্দিন সাহেব কোনো রকমে রিকশা বিদায় করে একদৌড়ে হাইকোর্ট এরিয়ায় ঢুকে গেলেন।
কখনো সখনো হাইকোর্ট এরিয়াও নিরাপদ নয়।
.
– ‘ভাইজান, আমাদের ক্ষমা করবেন। কিছু করার ছিলনা আমাদের। ফরেন্সিক রিপোর্টে সব ফাঁস হয়ে গেছে।’
– ‘সজীব প্লিজ য়ু গো টু দা হেল। তোদের কোনো সাহায্য চাইনা। আমি আমার জন্য যথেষ্ট এখনও।’
– ‘সরি ভাইজান! আমাকে ক্ষমা করুন! আপনার ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে…’
– ‘সজীব স্টপ্ দ্যাট্!- কথা শেষ করতে দিলনা লোকটি। সজীব হাত জোড়, মাথা নিচু অবস্থায় চুুপ হয়ে গেল।
সজীব একজন পুলিশ অফিসার। ক বছর আগে পুলিশের চাকরির জন্য সে লোকটির কাছে ধরণা দেয়। তারপর বহু বুকিচুকি করে লোকটি মন্ত্রীর রেফারেন্স পাইয়ে দেয়। কিন্তু আজ সে লোকটির সামনে খুবই লজ্জিত।
খানিকপর মুখ খোলে লোকটি- ‘তুই কি মনে করেছিস? আমি কি কিছুই জানি না সজীব? পুলিশিপোষাক পরে তুই যে রাজনীতি আজ করছিস্- এসব রাজনীতি ক্ষমতা ছাড়াই, আমি দশবছর আগে আমি করে এসেছি।’
– ‘সামাদ মিয়ার হত্যার মামলাটা এখন সরকারী মামলা হয়ে গেছে ভাইজান। তাই আমাদের কিছু করার থাকলনা এখানে আর।’
– ‘সজীব আমি সব জানি। আমাকে শেখাতে আসিসনা।’
– ‘এটা সরকারি মামলা। আপনি যে খুব একটা সুবিধা করতে পারবেন, তাও মনে হচ্ছেনা!’
– ‘এখানের আবহাওয়া স্টপ্ হয় আমার অনুমতি নিয়ে। তুই আপাতত যেতে পারিস্!’
বিষম একটা আঘাত নিয়ে মিনিট পাঁচেক পর পুলিশ অফিসার সজীব গরাদ থেকে বেরুতে যাচ্ছিল। তখন লোকটি আবার বলল- ‘আমাকে সুযোগ দিস্ না আর! এই যাত্রায় যদি বেঁচে ফিরি তাহলে দশজন নিশ্চিত মরবে।
সজীব বেরিয়ে যাবার সময় আলিমুদ্দিন সাহেবের সম্মুখে পড়লেন। দুজন একে অন্যকে চিনে, তবুও ক্রস করার সময় কেউ কাউকে কেয়ার করলনা।
.
– ‘আসতে পারি?’
– ‘অঅঅহ্, উকিল সাহেব, আসেন- আসেন! কি অবস্থা?’
আলিমুদ্দিন সাহেব লোকটির মুখোমুখি বসলেন- ‘ভাই, পরিস্থিতি খুব খারাপ। ছেলেরা মিছিল-মিটিঙে পুরো ব্যাপারটা ক্যাঁচাল করে দিচ্ছে। মাত্রই কোর্টের সামনে আপনার পার্টির ছেলেগুলো মারামারি করল। এমনিতে আজ শেষ শুনানি। চাইছি জজসাহেব কে বলে ক’দিন পেছানো যায় কিনা। কিন্তু পরিস্থিতি এমন হলে আমাদের মামলা জেতা কঠিন হয়ে যাবে।’
– ‘হাহাহা… ধুর্ মিয়া, কি কন্ এসব? এটা ত মাত্র শুরু। এই মিছিল আজকে আগুন হবে- আগুন। হাহাহা…’
– ‘ভাই, একবার বোঝার চেষ্টা করেন!’
– ‘আলিমুদ্দিন সাহেব, এত বিচলিত হচ্ছেন ক্যানো? এ্যাঁ?’
– ‘ভাই আমার রিকোয়েস্ট…’
– ‘সরি, এটা আমি থামাতে পারবনা।’
– ‘আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আপনি মুক্তি পাবেন- বিশ্বাস রাখেন- আমার উপর!’
– ‘জীবনে কতবার মুক্তি পাইছি। আর ইচ্ছা নাই।’
– ‘ভাই প্লিজ!’
– ‘সরি ব্রো!’
আলিমুদ্দিন সাহেব হতাশ হয়ে গেলেন। অবশেষে তিনি তার শেষ চাল দিলেন- ‘কিন্তু আপনি ত এটা জানেননা, এই মামলা সরকার হাতে নিয়েছে।’
– ‘এই মামলা শুরু থেকেই সরকারের হাতে ছিল আলিমুদ্দিন সাহেব।’
আলিমুদ্দিন সাহেবের চোখ রসগোল্লা হয়ে গেল- ‘এ্যাঁ?’
– ‘এই মামলার রায়ও হয়ে গেছে। আমি বলব, রায়টা কি?’
– ‘আপনি বোধয় অসুস্থ। ভাই, আপনি বরং বিশ্রাম নেন কিছুক্ষণ!’
– ‘আলিমুদ্দিন সাহেব!’
– ‘জ্বি ভাই!’
– ‘রাজনীতি বুঝেন?’
– ‘ভাই আপনি একটু ঘুমান! আমি যাচ্ছি। পরে আসব।’
লোকটি খিক্ খিক্ করে হেসে উঠলেন- ‘উকিল সাহেব, আমি ঠিকাছি।’
আলিমুদ্দিন সাহেব উঠে দাড়ালেন। হেটে গরাদের বাইরে এসে বললেন- ‘এ্যাই সেন্ট্রি- সেন্ট্রি!’
৮
রাত নটা বাজে। কোথাও জীপগাড়ির মোটরের শব্দ হচ্ছে। সেই সাথে হালকা তালির শব্দ। এত রাতে তালি বাজাবে কে?
লোকটি জেলের ভেতর থেকে এসব শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। সে দেয়ালে কান লাগিয়ে দিল- নিশ্চিত হবার চেষ্টা করল- হ্যাঁ, আরে এই ত! দেয়ালে গাইতির আঘাত হচ্ছে না? সে আরো মনযোগী হল।
ঠান্ডামাথায় নেতা সামাদের হত্যার অপরাধে আদালত আসামি কে ফাঁসির রায় শুনালো।
কাল সকাল ভোর ছয়টায় তার ফাঁসি।
এর ভেতরে সে দেয়ালে গাইতির শব্দ আরো গাঢ় ভাবে শুনতে পেল। কি হতে চলছে ভেবে তার ভেতর ধুকধুক্ করছেনা। কারণ সে জানে যা হবার তা বহু আগেই হয়ে গেছে। এখন শুধু তার দেখে যাওয়াটা বাকি।
– ‘ভাইয়া!’
– ‘কে?’
– ‘ভাইয়া, আমি ঈভা বলছি- এদিকে তাকাও!’
লোকটি মাতালের মত মাথা তুলল- ‘বোন, তুই!’
– ‘জ্বি হাঁ আমি!’
– ‘তো তুই ওখানে দাড়িয়ে ক্যানো? ওমা! ভেতরে আয়! আমার পাশে বস্- আয়!’
– ‘নাহ্ ভেতরে আসবনা।’
– ‘ক্যানো রে?’
– ‘অপরাধী কখনও কারো স্বজন হতে পারেনা!’
– ‘হাহাহা… এই পাগলি- কি বলিস এসব? ভাই কখনও অপরাধী হতে পারে নাকি? এ্যাঁ?’
– ‘অপরাধী সবসময় অপরাধীই হয়। পৃথিবীর সমস্ত অপরাধী একটা সম্প্রদায়। তাদের বুকে অস্ত্র ঠেকান হয়, ভালোবাসা নয়।’
– ‘আচ্ছা এসব তর্ক পরে হবে। তুই আগে ভেতরে আয়! আমার পাশে বসতো একটু বহুদিন তোর হাত ধরিনি।’
– ‘না ভাইয়া, আমি বসবনা। চলে যাব। তবে তোমাকে কিছু কথা বলতে এসেছি। বলতে পারো একটা অফার নিয়ে এসেছি।’
– ‘বাব্বাহ্! দারুণ কথা বলা শিখেেছিস ত দেখি। ও আর কি- উকিলরা বেশরমই হয়। তাদের আবেগ হয়, আবেগহীন সন্ত্রাসী। তারা আমার চেয়েও বড় অপরাধী। আচ্ছা ঠিকাছে ওখানে দাড়িয়ে বল্, যা বলবি!’
ঈভা তার ভায়ের এসব কথায় পাত্তা দিলনা- ‘ভাইয়া, তুমি হয় ত ভাবছ পালিয়ে যাবে। তুমি চাইলে বহু আগে পালাতে পারতে। জানি, তোমাকে এখানে কেউ আটকাতে পারবেনা। চারদিকে তোমার লোকজন ওৎপেতে আছে। কিন্তু তুমি কি জানো?- তোমার উপর ব্রাশফায়ারের হুকুম আছে।’
লোকটি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। আবার চোপ্ হয়ে গেল। ঈভা আবার বলল- ‘কিন্তু ফেরার হয়ে কয়দিন বাঁচবে তুমি?’
– ‘জানিনা।’
– ‘আমি তোমার কেসটা রি-ওপেন করছি। আপিল বিভাগ আমাকে দুই দিনের সময় দিয়েছে। এই দেখো কাগজ!’ ঈভা তার ভাইকে গরাদের বাইরে থেকে একতাড়া কাগজ উঁচিয়ে দেখাল।
লোকটি দৌড়ে সামনে এসে গরাদের শিক ধরে দাড়াল।
ঈভা দু’কদম পিছিয়ে গেল- ‘এখন তোমার সামনে দুটো অপশন। হয় আজরাতে পালিয়ে জীবনমৃত্যুর মুখোমুখি দাড়াবে। না হয়, আরেকটা নতুন জীবনের ডাকে সাড়া দিবে।’
চাদর জড়ানো গায়ে লোকটি তখনও চোপ্ হয়ে তার বোনের চোখের দিকে তাকিয়ে দাড়িয়ে আছে। তার চোখে নির্লিপ্ততা। ঈভা আবার বলল, ‘আমার উপর বিশ্বাস রাখো! আমি পারব।’
পনের মিনিট পর লোকটি পরাজিত ব্যাক্তির মত গরাদের শিক ধরে বসে পড়ল মাটিতে। ঈভাও হাটু রেখে বসল- মুখোমুখি। লোকটি মাথা তুলে ছলছল দৃষ্টিতে চেয়ে বলল- ‘আমি খুনি নই রে, বোন!’
ঈভা বলল- ‘ব্যস্ আর বলতে হবেনা!’
৯
পুরো আদালত স্তব্ধ হয়ে গেছে।
.
এমনকি সরকারী দলের উকিল মিসেস জয়া সেনও পুরো ‘থ’ খেয়ে গেছেন। এমন একটা কাঁচা মেয়ে তার বিশ বছরের উকিলাতি জীবন কে এই চোদ্দদিনে হেল করে তুলল।
এই মেয়ে এতসব তথ্য পেল কোথা থেকে?- ভেবেই কূল পাচ্ছেননা সময়ের শক্তিশালী লয়ার মিসেস সেন।
পুরো ওপেন এন্ড সাট কেস। এটা আবার রিকোভার করে লাগাতার চৌদ্দদিনে এমন আলোর মুখ দেখাবে- এরমটা জজসাহেবও ভাবতে পারেননি। আজকেই বোধয় এর দলিল গুলোর উপর ভিত্তি করে রায় শুনিয়ে দিতে হবে- এমনটা ভাবছেন জজসাহেবও।
জয়া সেন ঘামছেন। সময় আছে আর দশমিনিট। এই মেয়েটা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে টাইম তার চাইতে আরো স্লো মোশনে এগুচ্ছে।
– ‘সুতরাং ইয়র অনার, আমি আগেই বলেছি যে, যেদিন মিস্টার সামাদ খুন হন, ঐদিন আমার মক্কেল ছিলেন স্বয়ং মিস্টার সামাদের তৃতীয় স্ত্রীর বাড়িতে। যেখানে খুন ও খুনির দূরত্ব ছিল একদিনের। এমন কি আমি এটাও প্রমান করে দিয়েছি যে, আমার মক্কেলের সাথে মিস্টার সামাদের স্ত্রী’র আজ থেকে চার বছর আগের একটা রিলেশন ছিল। মিস্টার সামাদ ত তার তৃতীয় স্ত্রী কে তালাক দিয়েছেন। সুতরাং এই খুন না পরকীয়া ঘটিত, না কোনো রাজনৈতিক ঘটিত- যদিও আমার মক্কেল ছিল সামাদের ডান হাত। আজ থেকে বেশ কবছর আগে এক মদের বারে তাদের দুজনের পরিচয়। সেই থেকে তারা একে অন্যের হয়ে কাজ করে। এমন কি মৃত্যুর আধ ঘন্টা আগেও তাদের মধ্যে ফোনালাপ হয়। সেই বাবদ তার ফোনকল রেকর্ডসের সহ যাবতীয় তথ্যপত্রগুলো আপনার সম্মুখে আছে। অতপর মহামান্য আদালতের কাছে এই অনুরোধ, আমার সমস্ত দলিলের উপর যাচাই বাচাই করে, আমার মক্কেল কে বেকসুর খালাস প্রদান করা হোক। পাশাপাশি এই দাবিও জানাই আমাদের মহান জননেতা সামাদ হত্যার বিচার হোক- সেজন্য একজন নির্দোষ ব্যক্তি দন্ডিত না হয়ে যান, তাই এই মামলা ধীরে সুস্থে পূর্ণরূপে তদন্ত করা হোক!’
আদালতকক্ষে আবার নিরবতা নেমে এলো। এমনকি জয়া সেনও একবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে আবার নিশ্চুপে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন।
.
একসময় জজসাহেব কেঁশে উঠলেন- ‘সমস্ত সাক্ষপ্রমান ও দলিলাদির ভিত্তিতে এই মামলা থেকে আসামিকে স্বসম্মানে মুক্তি দিচ্ছে। আর পুলিশকে আদেশ দিচ্ছে যে সামাদ হত্যার পুনরায় তদন্ত তদারক করা হোক।’
.
রায় শেষে সবাই আদালতকক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু ন্যায়ের চোখবাঁধা দাড়িপাল্লা মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে নিজের আসন ছাড়তে পারলনা ঈভা।
১০
সেদিন আদালত থেকে ফেরার পথেই নিজের ভাইয়ের জন্য করা পার্সপোট ভিসা হাতে গুঁজে দিয়ে বলল- ‘ভাইয়া, তুমি এখান থেকে পালিয়ে যাও!’
লোকটি সেদিন কিছুই বলতে পারলনা, তার বুক ভেঙে শুধু একটি শব্দই বেরিয়ে আসলো- ‘ঈভাহ্! বোন আমার।’
১১
লোকটি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাবার পরদিন থেকে চারিদিকে উত্তপ্ততা ছড়িয়ে পড়ল। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া রাস্তাঘাটে আগ্নিসংযোগ ও আরো কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে থাকে। পুলিশের সাথে দাঙ্গাহাঙ্গামা সহ এক পক্ষের লোক অন্য পক্ষের লোকের উপর গুলাগুলি ছুড়াছুড়ি চলতে থাকে। মিছিলমিটিঙে পুরো একমাস প্রচুর হতাহতের ঘটনা ঘটে।
অবশেষে সরকার পরিস্থিতি আওতাধীন করার জন্য আবার কেসটা রি-ওপেন করে। কিন্তু সে সূত্রে পুলিশ জেনে যায়, লোকটি এখন ফেরার। তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে তার বোন ঈভা।
এক সকালবেলা ঈভাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেই সাথে তার উকিলাতি সনদপত্র বাতিল করে দেয়া হয়।
.
পুলিশের সাধারণ জিগ্গাসাবাদ তার থেকে কোনো প্রকার আসামির হদিস না পেয়ে, সরকারী পক্ষের উকিল তার উপর হাইকোর্ট থেকে তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে নেয়।
.
দুইদিন রিমান্ড শেষেও তার থেকে কোনোরূপ তথ্য পাওয়া যাইনি। তৃতীয়দিন একমহিলা পুলিশ তার মুখোমুখি বসেন।
– ‘আপনার নাম কি?’
যুলুম সহ্য করা চোখ খুলে সে বলল- ‘ঈভা।’
– ‘আপনি এত অত্যাচার সহ্য করছেন ক্যানো, ঈভা?’
ঈভা নিশ্চুপে হাসি দিল। এরম পুলিশমহিলাগুলো কারো ডোন্ট কেয়ারে অপমানিতবোধ করেননা।
– ‘আচ্ছা আপনার বাবার নাম কি?’
– ‘মোজাম্মেল হক।’
– ‘আপনার মায়ের নাম কি?’
– ‘সায়েরা বেগম।’
– ‘আপনার ভায়ের নাম কি?’
ঈভা আবার নিশ্চুপে হাসল।
– ‘ঈভা বলুন, আপনার ভায়ের নাম কি?’
ঈভা ভাঙা চেহেরা আলুতালু চুলের মাথাটা তুলে বলল- ‘জানিনা, আমার কোনো ভাই নেই।’
– ‘অঅঅ আচ্ছা।’
– ‘ত সে কে যার পক্ষ হয়ে আপনি এই মামলাটা লড়েছেন?’
– ‘সে আমার মক্কেল।’
– ‘তার নাম কি?’
– ‘ভুলে গেছি, জানিনা।’
– ‘সে এখন কোথায়?’
ঈভা য্যানো সত্যি রাগ করল- ‘কেস শেষ হয়ে গেলে মক্কেলের খবর রাখে কেউ?’
– ‘কিন্তু ক্যানো?’
– ‘আমি একজন উকিল- কারো ফ্যামেলি ডাক্তার না।’
– ‘অহ্ তাই? আচ্ছা আপনারা ক ভাইবোন?’
– ‘একভাই একবোন।’
– ‘আপনার ঐ একভাইটা কই?’
– ‘মরে গেছে।’
খুব কঠিন একটা শ্বাস ফেলে পুলিশ মহিলাটি বলল- ‘ঈভা!’
– ‘হুম্।’
– ‘ক্যানো ঈশ্বর আমাকে বোন দেননি জানেন?’
ঢুলুঢুলু চোখে ঘুম নিয়ে ঈভা মাতালের মত তীর্যক হাসি মুখে বলল- ‘ক্যানো?’
– ‘কারণ ঈশ্বরের পূজায় বসাতাম আমি।’
ঈভা তখন আস্তে ঢলে পড়ল চেয়ার থেকে।
.
পরদিন বিকাল তিন ঘটিকার সময় মেডিকেলে অতিরিক্ত শ্বাসকষ্টের কারণে ঈভার মৃত্যু হল।