মাহবুব আলম কাউসার:
টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিলো।
রূপা বারান্দার শিকল ধরে নিচু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। রাস্তার লাইটগুলি জ্বলছিলো। তাদের বারান্দা থেকে বড় রাস্তা সুন্দর দেখা যায়। রাত তখন বেশি হয় নি। সবে নয়টা বাজে। চারপাশ ঘোর অন্ধকার তখন। রাস্তায় গাড়িগুলি একটার পর একটা ছুটছিলো। কোনো তাড়াহুড়ো নেই। হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়িগুলো। কী সুন্দর, একটার পর একটা সারি করে যাচ্ছে! যেনো মনে হচ্ছে, গাড়িগুলো এক একটা পিঁপড়া। তাদের মাথায় হেডলাইট লাগানো। ঠিক এমনিভাবেই একটি বড় পিঁপড়া তার হেডলাইট জ্বালিয়ে তাদের গেট দিয়ে ঢুকবে, রুপা সেজন্যই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। কিন্তু বড় পিপড়াটা এখনো আসছেই না। মা কখন থেকে দুধ খাওয়ার জন্য বায়না করছে। তার দুধ ডিম মোটেও খেতে ইচ্ছা করে না। মা কতো বড় তবু তার অনিচ্ছার কথা বুঝতেই পারে না।
ভেতর থেকে আচমকা মায়ের ডাক শুনে রুপার হুস এলো। মা বললেন, ‘বারান্দায় তুই কী করছিস রূপা? দুধটা খেয়ে নে মা!’
রুপা বিরক্ত হয়ে বললো, ‘কতোবার বলবো মা। দুধ আমার ভালো লাগে না!’
মা বললেন,’ভালো না লাগলেও খেতে হবে। তুই দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছিস যে।’
মায়ের কথার তীব্র প্রতিবাদ করে রূপা বললো, ‘মোটেও না। ভাল না লাগলে কেউ খেতে পারে? তুমি এতো বড় তাও তোমার এই বুদ্ধিটা হয় না কেনো মা?’
চার বছরী মেয়ের অভিমানী কথা শুনে শাহনাজ হেসে ফেললেন। তিনি বারান্দায় মেয়ের পেছনে গিয়ে বললেন, ‘ঠিকই বলেছো তুমি রূপা! তোমার এই বুড়ো মায়ের একটুও বুদ্ধি হয় নি।’
রুপা তখন কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলো। আর তখনি সে দেখলো, বড় পিঁপড়াটা গেটের বাইরে ইনডিকেটর লাইট জ্বালিয়েছে। লাইট জ্বলছে আর নিভছে। দারোয়ান তাদের গেট খুলে দিলো। রূপা তখন চেঁচিয়ে উঠল,’বাবা এসেছে! বাবা এসেছে!’ বলে নিচে ছুটে চললো।
শাহনাজ বলছেন, ‘এভাবে ছুটো না মা! অন্ধকারে সিঁড়ি থেকে পড়ে পা ভাঙবে তো!’
রুপা মায়ের কথা একদমই শুনলো না। সে সিঁড়ি ভেঙে একদম নিচ তলায় চলে গেলো। তার পিছু পিছু শাহনাজও এসেছেন।
মেরুন কালারের গাড়ি থেকে যেই রাতুল সাহেব নামলেন অমনি রূপা ‘বাবা বাবা’ বলে রাতুল সাহেবের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো।
রাতুল সাহেব মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে কপালে চুমু খেলেন। রূপা দেখলো বাবার হাতে নীল একটা বাক্সে কী যেনো একটা র্যাপিং করা। এটাতে তার জন্মদিনের উপহার, এটা তার বুঝতে মোটেও কষ্ট হলো না। সে বললো,’বাবা এটার ভেতর কী?’
রাতুল সাহেব হেসে বললেন,’এখন তো বলা যাবে না মামণি! এখন বললে তো মজাই শেষ!’
রুপা বললো,’আমার জন্মদিনের উপহার বাবা!’
রাতুল হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ।’
রুপা বললো, কী আছে এটায়। বলো না বাবা!’
রাতুল মাথা নেড়ে বললেন, ‘উঁহু। এখন তোমাকে কিচ্ছু বলা যাবে না। ঠিক বারোটায় যখন কেক কাটা হবে তখন তুমি নিজের হাতেই এটা খুলবে।’
রূপার তবু যেনো তর সইছে না। কী আছে নীল বক্সটার ভেতর। সেটা না দেখা পর্যন্ত যে তার শান্তিই হচ্ছিলো না!
কখন বাজবে রাত বারোটা? কতোক্ষণ আর সে অপেক্ষা করবে। তার যে চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে। কিন্তু বাবার উপহার না দেখে সে কিছুতেই ঘুমুবে না!
অবশেষে ড্রয়িংরুমের দেয়ালঘড়িটায় রাত বারোটা বাজার ইঙ্গিত হলো। রাতুল সাহেব ডাকলেন, ‘রূপা মা কোথায় তুমি! এখানে আসো মা!’
রুপা গুটিগুটি করে ড্রয়িংরুমে চলে আসলো। এসেই সে নীল বাক্সটা খুলতে চাইলো। রাতুল সাহেব বললেন,’এখনি নয় মামণি! আগে কেক কাটা হোক তারপর।’
রূপা কেকের সামনে চলে আসলো। ঘরটায় অনেক রকমের বেলুন ঝুলানো হয়েছে। দেয়ালের মাঝখানে সুন্দর করে লেখা আছে হ্যাপি বার্থডে রূপা!
রুপা কেক কাটলো। তার বাম পাশে মা আর ডানপাশে বাবা। বাবা-মা দু’জন তাকে কেক খাইয়ে দিলো।
রূপা এবার অধীর হয়ে বললো,’বাবা এবার উপহারটা খুলি?’
রাতুল সাহেব মৃদু হেসে বললেন, ‘খোলো।’
রূপা তার উপহার বাক্স খুলে তো একদম অবাক। কী সুন্দর একটা পুতুল! চোখগুলো সোনালি। মুখটা হাসি হাসি। যেনো তার দিকে তাকিয়ে সে হাসছে।
রাতুল সাহেব বললেন,’মামণি এটার সুইচটা অন কর তো। দেখ, কী বলে।’
রূপা সুইচ অন করতেই পুতুল বলে উঠলো, ‘হ্যাপি বার্থডে রুপা। হাউ আর ইউ?’
রুপার চোখ যেনো ঝলমল করে উঠে। তার যেনো বিশ্বাসই হতে চায় না। পুতুল তাকে জন্মদিনের উইশ করছে!
রাতুল সাহেব বললেন,’মামণি কেমন হলো তোমার জন্মদিনের উপহার?’
রূপা এতোটাই উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলো যে কিছু বলার ভাষাও খুঁজে পাচ্ছিলো না। অবশেষে সে কোনোমতে বললো,’খুব সুন্দর বাবা!’
এরপর থেকে সে পুতুলটিকে একটুও কাছের আড়াল করতো না। পুতুলের চুল আচড়ে দিতো। পুতুলকে গোসল করিয়ে দিতো,পুতুলের দাঁত মেজে দিতো। পুতুলটা একদম তার সব কথা শুনতো। আর রাতে যখন সে ঘুমুতে যেতো পুতুলকে চাঁদ মামার গান শুনিয়ে ঘুম পাড়াতে হতো। পুতুল অবশ্য ঘুমাতো না, উল্টো সে নিজেই ঘুমিয়ে যেতো!