শেখ নাঈমুল ইসলাম : সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় দেওবন্দের ওলামায়ে কেরাম রাজনৈতিকভাবে দুটি ভাগে ভাগ হয়ে পড়েন । দেওবন্দের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত মূলধারার অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম এবং তাবলীগ জামাতের মুরব্বীগণ দেশভাগের বিরোধিতা করেন অপরদিকে আশরাফ আলী থানবী রহঃ এর অনুসারীগণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এমনকি দুই পাকিস্তানেই তার ঘনিষ্ঠ দুই শাগরেদ পাকিস্তানের প্রথম পতাকা উত্তোলন করেন । এবং এ কারণেই তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষ নেননি ওদিকে যারা দেশ ভাগের বিরোধী ছিলেন তারা পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক , সামাজিক এবং ধর্মীয়ভাবে কোণঠাসা হয়ে ছিলেন এবং সংগত কারণেই তারা স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। এখন প্রশ্ন হল মাদরাসায় স্বাধীনতার ইতিহাস চর্চা ,জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সাথে এর কি সম্পর্ক ? হ্যা গভীর সম্পর্ক আছে , বাংলাদেশ সৃষ্টির পরে নানা কারণেই কওমি মাদরাসার সার্বিক নেতৃত্বে চলে আসে পাকিস্তানপন্থি ওলামায়ে কেরাম ,কওমি মাদরাসা কেন্দ্রিক রাজনীতির ময়দানেও তারা সরব হয়ে ওঠে ফলে স্বাভাবিকভাবে কওমি মাদরাসায় তাদের চিন্তার প্রভাব বিস্তার লাভ করে এর দ্বারা কওমি মাদরাসায় অন্যসবকিছুর চেয়ে অবহেলিত হয়ে পড়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বিষয়াবলী, জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা উত্তোলন। একসময় যারা মাদরাসার মাঠে বুক ফুলিয়ে ভোকাল কর্ড ছিঁড়ে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ভক্তির সাথে পাক সার জমিন সাদ বাদ গাইতো বাংলাদেশ হওয়ার পরে আমার সোনার বাংলা হয়ে গেল তাদের কাছে কুফরি, যারা পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলনকে পূন্যের কাজ মনে করত বাংলাদেশ হওয়ার পরে পতাকা উত্তোলন সম্পর্কে ফতোয়া খোঁজা শুরু করে দিল, যারা পান খেতে খেতে নারায়ে তকবির বলে লাড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানের ইতিহাস বীরত্বের সাথে পড়াতেন বাংলাদেশের ইতিহাস পড়ানো তাদের জন্য হয়ে দাঁড়ালো হিন্দুদের ইতিহাস পড়ানোর সামিল, যারা জিন্নাহর স্তুতি গাইতে গাইতে মুখে ফেনা তুলে ফেলত শেখ মুজিব তাঁদের কাছে হয়ে উঠলো ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি।
আজ ২০১৮ সালে এসেও অধিকাংশ মাদরাসা শিক্ষার্থীরা সেই জাহেলী যুগের বংশপরম্পরার মত স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিদ্বেষ বহন করে যাচ্ছে । মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যার কথা বললে এখনো অনেকেই বলে আরে মিয়া! সেই পুরনো আমলে কে কি করছে তা কয়া কোন লাভ আছে নি ? বর্তমান সরকারের জুলুম নির্যাতন নিয়া কথা কও। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বললে এখনো শুনতে হয় ধুর মিয়া !এই মালাউন গে জন্যি আজকে একটা ইসলামী রাষ্ট্র ভাইঙ্গে খান খান হয়ে গেল , এগুলো সব ঐ শালার বিটাগে কারনেই হইছে নালি পরে আজকে আমরা একটা এসলামী রাষ্ট্রে থাকতি পারতাম। হায়রে পেয়ারে পাকিস্তান !
এই যে স্বাধীনতার সাতচল্লিশ বছর পরে এসেও এত শত সংখ্যক ছাত্র, এত টগবগে তরুণ প্রজন্ম স্বাধীনতা কে আপন করতে পারলো না, এর দায় কার ? প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এ দেশে জন্ম নিয়ে, এ দেশের আলো বাতাস গায়ে মেখে, এ দেশের অন্য ভোগ করেও এক ভিন্ন দেশের বাসিন্দা হয়ে আছে। সমাজের মূল ধারার সাথে একীভূত হতে পারে নি আজও। সমাজের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে থাকতে এক ধরণের হীনমন্যতায় ভুগে এখন মানুষিকভাবে উগ্র হয়ে উঠছে বর্তমান প্রজন্ম। একই দেশে বাস করে, একই ধর্মাবলম্বী হয়েও আজকে একে অপরের প্রতি চরম ঘৃণা পোষণ করছে। এর সবকিছুর পিছনে আছে স্বাধীনতাকে মানতে না পারা, দেশকে আপন না ভাবা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারন না করা আর এগুলো তাঁদের ভিতরে আসে নি মুক্তিযুদ্ধকে জানতে না দেওয়ার কারণে। একটি শিশুর মতাদর্শ ঠিক হয় সেই শৈশবকাল থেকেই, আর তখন থেকে পড়াশোনা শেষ করে কর্মজীবনে যাওয়া অবধি যদি তাকে তার সমাজ , তার সংস্কৃতি, তার দেশ, তার স্বাধীনতাকে জানতে না দেওয়া হয় তাহলে তার মানুষিক বিকাশ কীভাবে ঘটবে ? সে দেশকে কী করে আপন ভাববে ? দেশপ্রেমে কীভাবে উজ্জীবিত হবে ?
কওমি মাদরাসা কতৃপক্ষের কাছে আকূল আবেদন , এই এত বছর পরে এসেও সিলেবাসে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ানো হবে কি ? অন্তত নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হলেও ……।