শুক্রবার, মার্চ ৩১, ২০২৩
Home > গল্প > আল্লামা ক্বারী এরশাদ হোসাইন: একটি পতিত নক্ষত্রের গল্প

আল্লামা ক্বারী এরশাদ হোসাইন: একটি পতিত নক্ষত্রের গল্প

Spread the love

মোরশেদ আলম : সমুদ্রে যখন ঝড় আসে অনেক কিছুই তখন উলট-পালট হয়ে যায়। বিধ্বস্ত ঘর-বাড়ি মেরামত করে মানুষ তখনও ঘুরে দাঁড়ায়। আবারো কর্মচঞ্চল হয়ে উঠে পরিবেশ। কারণ, জীবন এখনো বাকি আছে। কিন্তু স্বয়ং জীবনের উপর যদি ঝড় আসে তখন কী হয়? জীবনের পাতাগুলো কি আর সজিবতা ফিরে পায়? জীবন পরিবেশের চারিপাশ তখন কেমন দেখায়? জানিনা সে প্রশ্নের কী উত্তর হতে পারে। কিন্তু আপনি যদি রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে চলে আসেন, তবে বুঝতে পারবেন জীবনের উপসংহারে গাণিতিক সূত্র সবসময় কার্যকর থাকে না। সিলেট ভিত্তিক শিল্প, সাহিত্য ও গবেষণামূলক সংগঠন পাঠক ফোরাম’র অনুসন্ধানী টিমের হয়ে কাজ করতে গিয়ে জীবনের এমনি এক গল্প আমাদের শুনতেনতে হয়েছে, যা শোনার জন্য আমাদের কান প্রস্তুত ছিলো না। অদৃশ্যে অংকিত এমন কিছু চিত্র আমরা ধারণ করেছি যা সহজেই চিহ্নিত করা যায় না। বাসাতে ভেসে চলা চাঁপা আর্তনাদগুলো ,যা অনুভব করার জন্য সাধারণ হৃদয় যথেষ্ট ছিলো না-আমাদেরকে তাও অনুভব করতে হয়েছে যথেষ্ট ধর্য্য নিয়ে। কি সেই গল্প?

গল্পের নাম আল্লামা ক্বারী এরশাদ হোসাইন। ৯৭ বয়সের এ বয়োবৃদ্ধ আলেম এমন এক ব্যক্তির নাম,কালের স্বাক্ষী হয়ে যিনি বলে দিচ্ছেন,বিপন্ন,দুর্গত,পরাজিত জীবনের ইতিকথা।বলে দিচ্ছেন,ভয়াবহ অতীত ও রক্তাক্ত বর্তমানের ইতিবৃত্ত।। পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ের এই জনক একাধারে আলেম,ক্বারী,শায়খুল হাদীস ও ব্যবসায়ী ছিলেন। মংডুর উদং এলাকায় তাঁর ছিলো তিন কাঠা জমি এবং প্রায় ৫০ লাখ টাকা মূল্যমাণের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান।
এসব বস্তুগত সম্পদের বিনাশ করেই যদি থেমে যেতো জালিমরা!

ছোটবেলায় গ্রামের মাদরাসায় পড়াশোনার হাতেখড়ি হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতির কারণে তখন ভারতে চলে যান তিনি। বাকি পড়াশোনা দারুল উলুম দেওবন্দেই শেষ করেন। সেখানে হজরত হুসাইন আহমদ মাদানী রহ’র সোহবতে থাকেন দীর্ঘ আট বছর। পূর্ণ হয় আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ। এ সময় দেওবন্দের কেরাত বিভাগের প্রধান মাওলানা ক্বারী হিফজুর রহমানের কাছ থেকে কেরাতের উপর বিশেষ সনদ “সাব’আ” অর্জন করে দেশে ফিরেন।

উদং এর দাওরায়ে হাদিস মাদরাসাটি তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রথম স্থাপনা। কর্মজীবনের প্রথম পর্যায়ে তিনি এর শায়খুল হাদীস ছিলেন। বাড়তে থাকা কর্মপরিধির এক পর্যায়ে তাঁর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় রেঙ্গুনের সুফিয়া ও নোমানিয়া মাদরাসা। যেগুলো একসময় দেশটির শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।

১৯৪৮-৫১ সাল। দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত রেডিও রেঙ্গুনের তিনি প্রধান ক্বারী। সরকারি এ প্রতিষ্ঠানে তাঁর নিয়োগ প্রমাণ করে রোহিঙ্গাদের ভূমি সমস্যা একটি সাম্প্রতিক ইস্যু। যার সাথে ইতিহাসের কোনো সম্পর্ক নেই। খ্যাতির এক পর্যায়ে তিনি চলে যান মহানবীর (স) মদিনায়। ১৯৮৩-৮৬ সাল পর্যন্ত পবিত্র মসজিদে নববীতে দারস প্রদান করেন তখন। অসুস্থ মায়ের সেবার জন্য এর পর তাকে ফিরে আসতে হয় আরাকানে। নিবর্তন ও নির্যাতনের স্বাক্ষী হতে থাকেন তখন থেকেই।

মাদানী (র) এর দরসে বসে সহীহ বোখারী ও তিরমিযী এবং ইব্রাহীম বলিয়াভী (র) এর দরস থেকে মুসলিম শরীফের হ্যান্ড নোট তৈরি করেন তিনি। অমূল্য এই সম্পদগুলো যদি জীবনের বিনিময়ে হলেও অক্ষত থাকতো!

অসংখ্য ঘটনার মাঝে ২০১২ সালের একটি ঘটনা বলেন তিনি। উদং এর একটি মসজিদে তখন তাঁর ভাতিজা আমির ফজল সহ তাবলীগ জামাতের ১২ জন দাঈকে শহীদ করা হয়। তখন অসংখ্য আলেম সহ আকিয়াবের প্রায় দুই হাজার মানুষকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তারা কোথায় আছেন বলতেই তাঁর নির্বাক অবয়ব থেকে ভেসে আসে নিযার্তনের শব্দ,চিত্র,আর্তনাদ ও আহাজারি!

এটাই গতকালের শেষ সাক্ষাৎকার ছিলো। এর পর আর সাক্ষাৎকার নিতে ইচ্ছে হয় নি। ফিরে আসছিলাম হিমছড়ির পাহাড়-সাগরের মাঝ দিয়ে। ভাবছিলাম জীবন ঝড় আর সামুদ্রিক ঝড়ের মধ্যে পার্থক্য কতো বিস্তর!পাহাড়সম এমন অনেক উচ্চ মর্জাদাশীল ব্যক্তিকে নি:স্ব বানিয়ে দেয় জীবনঝড় যা সামুদ্রিক ঝড় পারে না।

Facebook Comments