বারান্দায় নাতাশা একা।নাতাশা হেলেদুলে এগুচ্ছে। চৈত্রের তীব্র বাতাস নারকেল গাছ থেকে বেয়ে আসছে। আজ বৃষ্টি হবে নাকি?
নন্দীনি দেখলো নাতাশার শুভ্র সিল্কি পাতলা চুলগুলি উড়ছে,এতো সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে!
বারান্দার দরজা ধরে দাঁড়াতেই নাতাশা মাকে দেখতে পেয়ে ছুটে আসতে চাইলো। মেয়েটা মেঝেতে ধুমরে পড়ার আগেই নন্দিনী তাকে ধরে ফেললো। নাতাশা অনবরত হেসেই যাচ্ছে। মেয়েটা হাসলে মেয়েটার গালে টোল পরে। তখন তাকে এতো সুন্দর লাগে! নন্দিনী নাতাশার কপালে চুমু খেলো।
নাতাশাকে কোলে নিয়ে নন্দিনী বারান্দার একদম রেলিং এর পাশে চলে এলো। বাতাসে নন্দিনীর ওড়না উড়ছে। নাতাশার চুলগুলোও উড়ছে। বাইরের দমকা বাতাসে নারকেল গাছের পাতাগুলো অদ্ভুতভাবে নড়ছে।
নাতাশা বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে আর মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে ই ই ই জাতীয় অদ্ভুত শব্দ করে হাসছে। যেনো প্রকৃতিময় বৃষ্টির দিনে এমন আবহাওয়া দেখে সে উদ্বেলিত!
বাতাস খুব বেশি হচ্ছে। দমকা বাতাসের সাথে সাথে বারান্দায় বাইরের ধুলাবালি এসে ঢুকছে। নন্দিনী ঘরে এসে দরজা ভেজিয়ে দিলো।
নন্দিনী ঘরে এসে ঘড়ি দেখতে চাইলো। আর অমনি ইলেক্ট্রেসিটি চলে গিয়ে পুরো ঘর অন্ধকার করে দিলো। এই বাড়িতে দিনের বেলা বারান্দা পর্যন্তই আলো আসে। বারান্দার চারপাশে অনেক গাছপালা থাকায় দেয়াল ভেদ করে আলো ঘরের ভেতর আসতে পারে না।
নন্দিনী তার স্বামীকে নিয়ে থাকে ধানমণ্ডি আটের একটা মাঝারি সাইজের দোতলা বাড়িতে। পুরানো আমলের বাড়ি হলেও বাড়িটা বেশ চমৎকার। খোলামেলা হওয়ায় সারাক্ষণই বারান্দায় হাওয়া-বাতাস ঢুকছে। হাওয়া বারান্দা থেকে আসছে ঘরে।
ঢাকা এসে শত বাধা বিপত্তিকে হার মানিয়ে নন্দিনীকে বিয়ে করে যখন শিমুল অতল সাগরে পড়লো, তখনি বোধহয় দেবদূত হয়ে এসেছিলেন এই বাড়ির মালিক।
এই বাড়ির মালিক থাকে সিঙ্গাপুর। আরো চার বছর আগেই তারা চলে গিয়েছিলেন। বাড়ির মালিক চলে যাওয়ার পর থেকেই তারা এই বাড়িটিতে থাকার অনুমতি পেয়েছে। ভাগ্যিস পেয়েছিলো!
বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
ঝুমঝুম বৃষ্টি। নাতাশা গভীর নি:শ্বাস ফেলছে। নন্দীনি লক্ষ্য করলো মেয়েটা ঘুমিয়ে গেছে। নন্দিনী তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আবার বারান্দায় চলে আসলো।
এখন একদম বাতাস নেই। বৃষ্টি হচ্ছে খুব। ইচ্ছা হচ্ছে বৃষ্টিতে ভিজতে। কিন্তু ভেজা সম্ভব না। শিমুলকে সে কথা দিয়েছে। বাসায় একা থাকার সময় সে বৃষ্টিতে ভিজবে না। সব থেকে বেশি আনন্দের সময় প্রিয় মানুষটির সান্নিধ্য না পেলে সেই আনন্দের যেনো কোনো মূল্যই থাকে না।
‘আফা! আফা!’
রোকেয়া ডাকছে। নন্দিনী ফিসফিস করে বললো, ‘আস্তে রোকেয়া! নাতাশা উঠে পড়বে।’
রোকেয়া এবার কিছু না বলে চুপ করে রইলো। সে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেনো একটা মূর্তি। আর ঘন ঘন নি:শ্বাস ফেলছে।
নন্দিনী বললো, ‘কী ব্যপার রোকেয়া কিছু কি হয়েছে?’
রোকেয়া থতমত খেয়ে গেলো। তার চোখেমুখে ভয়ের চিহ্ন ফুটে উঠছে,যেনো এক্ষুণি সে কেঁদে ফেলবে।
নন্দিনী বলল, ‘কী হয়েছে সেটা বলবে তো। না বললে আমি কী করে বুঝবো?’
রোকেয়া ভীত চোখে রান্নাঘরের দিকে ইশারা করলো।
নন্দিনী বলল,’রান্নাঘরে কী?’
রোকেয়া পর পর দু’বার ঢোক গিলে বলোল, ‘ভূত!’
নন্দিনী ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কী সব ফালতু কথা বলছো! ভূত আসবে কোত্থেকে। ভূত বলতে কিছু আছে নাকি?’
রোকেয়া এই বাড়িতে আছে প্রায় দেড় বছর হতে চললো। এই দেড় বছরে সে বহু মিথ্যা বলেছে। কাপ-ডিশ ভেঙেছে বেশ কয়েকদিন। নন্দিনী যখন বললো,’কাপ- ডিশ ভেঙেছো কী করে?’
রোকেয়া মুখ বাঁকা করে বলোল, ‘আমি কই ভাঙলাম? টিভির রুম থাইক্কা আইসাই তো দেহি ভাইঙ্গা পইড়া আছে। মনে হয় ভূতের কাণ্ড। আফনাদের এইহানে ভূত আছে।’
নন্দিনী রান্নাঘরে এসে দেখলো কোথাও কিছু নেই,পুরো ফাঁকা আর ঝাপসা অন্ধকার।
নন্দিনী বাতি জ্বালিয়ে বললো’,কোথায় কী? কী দেখে ভয় পেয়েছো?’রোকেয়া কোনো কথা বললো না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আর ঠিক তখনি নন্দিনী আবিষ্কার করলো, নাতাশার পানি খাওয়ার পটটি টেবিলের নিচে দু’টুকরো হয়ে পড়ে আছে। নন্দিনী প্রচণ্ডরেগে গিয়ে বললো,’রোকেয়া এটা ভাঙলো কী করে?’
রোকেয়া আমতা আমতা করে বললো,’ আমি নাতো! ভূত! ইয়া লম্বা। জানালার পাশে আইসা দাঁড়াইলো। আর অমনি আমার হাত থাইক্কা ফসকাইয়া পইড়াগেলো আফা!’
নন্দিনীর ইচ্ছা করছে রোকেয়ার গালে কষে একটা চড় দিতে। পট ভাঙার জন্য নয়। বানিয়ে বানিয়ে গুছিয়ে মিথ্যা কথাগুলোর জন্য।
অবাক নন্দিনী ।। মাহবুব আলম কাউসার

Spread the love
Facebook Comments